অসুস্থ মাশফির প্রেসক্রিপশন ফিরিয়ে দিলো পুলিশ

এস এম সরওয়ার পারভেজ।

১৮ ডিসেম্বর বুধবার বিকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে,উপ-পুলিশ কমিশনারের (তেজগাঁও বিভাগ) কার্যালয়ে মেইন গেটের উত্তরের ফুটপাথে একটি লাল রঙের লাগেজ পড়ে থাকতে দেখেন কনস্টেবল আল মামুন।

৭-৮ মিনিট লাগেজটির পাশে কাউকে না দেখে সন্দেহ হয় কনস্টেবল আল মামুনের। তাৎক্ষনিকভাবে বিষয়টি তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার কে জানায় সে।

তখন অফিস কক্ষে বিভিন্ন থানা থেকে আগত দর্শনার্থীদের সাথে কথা বলছিলেন উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার। কনস্টেবল আল মামুনের মুখে লাগেজটির কথা শুনে অফিসের গেটের বাইরে এলেন তিনি। গেটের বাম পাশেই ফুটপাথে প্রাচীর ঘেষে আনএটেন্ডেড অবস্থায় পড়ে আছে লাগেজটি।

প্লাস্টিকের কোণ দিয়ে কর্ডন (পরিবেষ্টন) করা হলো লাগেজটির চারপাশ। মোতায়েন করা হলে পুলিশ। কর্ডনকৃত ফুটপাথ পরিহার করে লাগেজ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের জন্য অনুরোধ জানানো হলো পথচারীদের। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্দ্ধতন কতৃর্পক্ষকে অবহিত করা হলো।

উপ-পুলিশ কমিশনার (তেজগাঁও বিভাগ) এঁর কার্যালয়ের চারপাশে স্হাপিত সিসিটিভি’র ডিভিআর সংরক্ষিত উপ-পুলিশ কমিশনারের অফিস কক্ষে। শুরু হলো সিসিটিভি ফুটেজ এনালাইসিস। কে, কখন, কিভাবে রেখে গেল এই লাগেজ? পায়ে হেঁটে নাকি গাড়িতে চড়ে রেখে গেল? ভূলে নাকি প্ল্যান করে? কি থাকতে পারে এই লাগেজে? বিস্ফোরক নাকি খন্ডিত মৃতদেহ? নাকি স্রেফ ভূলবশতঃ কেউ ফেলে গেছে লাগেজটি?

গত ২৪ জুলাই ঢাকার পল্টন মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে পরিত্যক্ত কার্টুনের ভিতরে বোমা এবং ২১ অক্টোবর ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ ব্রহ্মপুত্র সেতুর পাশে পড়ে থাকা এরকমই একটি ট্রলি ব্যাগ থেকে খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এনিয়েও মিল-অমিলের গন্ধ। তখন চারদিকে থমথমে হাওয়া!

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আসলো ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টীম। প্রথমে দূর থেকে, তারপর একদম কাছ থেকে- প্রায় মিনিট দশেক লাগেজটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলো বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টীমের সদস্যরা।

তারা নিশ্চিত হলেন লাগেজে খারাপ কিছু নেই। খোলা হলো লাগেজটি। দেড়-দুই বছর বয়সী বাচ্চার বেশকিছু জামা-কাপড়ের সাথে একটি লুঙ্গি ও একটি শাড়ি। এগুলোর নিচে বেশকিছু ফাইল। ফাইলে ঢাকা, নারায়নগনজ, মাদারীপুর, বরিশালের কয়েকটি হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন। যেখানে রোগীর নাম মাশফি, বয়স মাত্র ১৬ মাস।

পেসক্রিপশনগুলোতে রোগীর নাম পরিচয় যোগাযোগে মোবাইল নম্বর নেই। উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার নিজেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলেন এসব। তিনি এডিসি (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) ওয়াহিদুল ইসলাম ও এডিসি হাফিজ আল ফারুককে নির্দেশ দিলেন যেভাবেই হোক লাগেজের মালিককে খুঁজে বের করে তার কাছে লাগেজটি পৌছে দিতে। যত দ্রুত সম্ভব।

Post MIddle

পুলিশের আন্তরিকতায় লাগেজে পাওয়া প্রেসক্রিপশনগুলো দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ফোন করে জানতে চাওয়া হয় মাশফি’র কোন গার্ডিয়ানের এড্রেস বা মোবাইল নম্বর তাদের কাছে আছে কি না। তারা মাশফি’র কোন তথ্য দিতে পারলেন না।

কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে পাওয়া একটি প্রেসক্রিপশনে দেখা যায়, এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মাদারীপুরে অবস্থিত নিরাময় হাসপাতালের ডাঃ পি. কে. বৈদ্য (বিপ্লব) এঁর কাছে মাশফি’কে দেখানো হয়েছে। ফোন করা হলো নিরাময় হাসপাতালে। মাশফি’র চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে নিরাময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হলো মাশফি’র অভিভাবকের ঠিকানা দিতে।

প্রায় ৫০ মিনিট পর নিরাময় হাসপাতাল কতৃপক্ষ ফোন করে জানালো মাশফি’র বাবার নাম মাসুম। জানা গেলো মাসুমের ফোন নম্বর।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাসুম জানালো মাশফি তার ছেলে। ছেলের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসে লাগেজ হারিয়ে ফেলেছেন। যে লাগেজে ছিল তার ছেলের চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাগজপত্র।

মাশফি’র বয়স ১৬ মাস। ওজন ৭.৫ কেজি। বয়সের তুলনায় শারীরিক বৃদ্ধি কম হওয়ায় প্রায় বছর খানেক ধরে মাশফি’র মা-বাবা নিজেদের সর্বস্ব বিক্রি করে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশালের হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছে ছেলেকে নিয়ে। আজকেই মাদারীপুর থেকে ঢাকা এসেছে। পরদিন শেরেবাংলা নগরস্থ নিউরোসায়েনস হাসপাতালে মাশফিকে দেখানোর কথা।

ঢাকায় কোন আত্মীয়-স্বজন না থাকায় আগারগাঁওয়ে দূর-সম্পর্কের এক আত্নীয়ের সাথে দেখা করে স্ত্রী-পুত্র ও লাগেজসহ তেতুলিয়া পরিবহনে কৃষি মার্কেটে অবস্থিত সেই আত্নীয়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয় মাসুম। আগারগাঁও থেকে শ্যামলী হয়ে কৃষি মার্কেটের দিকে যাওয়ার পথে উপ-পুলিশ কমিশনার (তেজগাঁও বিভাগ) এঁর কার্যালয়ের সামনে টার্নিংয়ের সময় মাসুমের অগোচরে কেউ লাগেজটি বাস থেকে নামিয়ে ফেলে। আশেপাশে পুলিশের উপস্থিতির কারণে হয়তো লাগেজটি নিতে পারে নি আর।

লাগেজটি হারিয়ে পাগলের মতো কাঁদছিল মাসুম ও তার স্ত্রী। তারা ভেবেছিল মাসফি’র চিকিৎসা আর করানো হবে না। প্রায় বছর খানেক ধরে ঢাকা, নারায়নগনজ, বরিশাল, মাদারীপুরের যে কয়টি হাসপাতালে মাশফিকে দেখানো সবগুলো টেস্ট ও প্রেসক্রিপশন তো ঐ লাগেজে। যে জন্য ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে মাসুমকে।

মাসুমকে জানানো হলো লাগেজটি এখন তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার মহোদয়ের অফিসে। লাগেজটি মাসুমের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

২০ মিনিট পর সেই আত্নীয়সহ হাজির হলো মাসুম। অক্ষত অবস্থায় লাগেজটি পেয়ে আবেগাপ্লুত মাসুম ছেলের সুস্থ্যতার জন্য দোয়া চায় সবার কাছে।

পুলিশের সতর্কতা ও আন্তরিকতায় অসুস্থ সন্তানের হারানো প্রেসক্রিপশন ও প্রয়োজনীয় অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে পাওয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ কে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন শিশু মাশফির এলাকাবাসী।

পছন্দের আরো পোস্ট