স্মৃতির পাতায় আজীবন অমলিন ভার্সিটি জীবন

ভার্সিটি জীবনে স্মৃতির পাতায় আজীবন অমলিন হয়ে থাকবে আজকের দিনটা। হৃদয়ের গহীনে কখনো ভাললাগা, কখনো খারাপ লাগার অনুভূতি জাগরণ করবে সারাটাক্ষন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন প্রবীণ শিক্ষার্থী হিসেবে আজ রসায়ন বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিলাম। ঠিক হয়তো বিদায় নয় কিন্তু প্রস্থান তো হলো, এই চেনাজানা ক্লাশ, ল্যাব আর বিভাগ থেকে। আর হয়তো কখনো ছাত্র হিসেবে রসায়ন বিভাগে পদচারণা করা হয়ে উঠবে না। রসায়নের একটা ক্লাশ করার জন্য আর কখনো দৌড়ঝাঁপ করা লাগবে না। জীবনের বাঁকেবাঁকে হয়তো ফিরে আসবো কখনো কখনো প্রাক্তন ছাত্র হিশেবে এই রসায়ন বিভাগেই। এ যে আমারই প্রাণপ্রিয় রসায়ন বিভাগ। এই রসায়ন বিভাগেই তো কাটিয়ে দিয়েছে জীবনের অনেকটা সোনালী সময়। যেখানেই যাই স্মৃতির পাতায় পাতায় ঘুরেফিরে আসবে, রসায়ন বিভাগে কাটানো সময়গুলো, স্মরনীয় হয়ে থাকবে রসায়ন বিভাগের গ্যালারী -১ রুমটা। এই তো সেই চিরচেনা গ্যালারী -১।

যেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর এই গ্যালারীতেই ভাইভা দিয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। একদিন এই গ্যালারীতেই হয়েছিলো নবীন বরণ। এগুলো তো বেশিদিনের কথা নয়। নবীন হিশেবে ফুল দিয়ে ভালবেসে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নিয়েছিলো আমাদের প্রাণপ্রিয় রসায়ন বিভাগের বড় ভাইরা এবং রসায়ন বিভাগের পিতৃতুল্য গুণীশিক্ষকরা। আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। এমন কী আর বুঝি? সবে মাত্র কয়েকদিন হলো ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাশ শুরু হয়েছে। এরই মাঝে একদিন নবীন বরনের ঘোষনা আসলো।

শুনলাম নবীন বরন অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম হবে। ভাবলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পারফর্ম করি। বন্ধুরা মিলে করলাম রসায়ন বিভাগ নিয়ে রম্য ডিবেট। বন্ধুদের সেই হইহুল্লোড় আজও যেনো কানে বাঁজছে। আর আজ অশ্রুসিক্ত চোখে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে হলো এই গ্যালারী থেকেই। এইতো সেই চিরচেনা গ্যালারী-১। আমি আজ শুধু প্রবীণ, আমার জায়গায় এসেছে আর একদল নবীন। খেয়াল করে দেখলাম আজ ফার্স্ট ইয়ারের নবীন ছেলেদের হাসিমুখ, দু’চোখে স্বপ্ন, আনন্দে উচ্ছ্বাসিত। ভাবছি একদিন আমরাও এরকমই তো ছিলাম।

আজ খুব বেশিই মনেপড়ছে। আমাদের নবীন বরনের দিন মনে কতো আনন্দ উচ্ছ্বাস ছিলো। সেদিন যে ব্যাচের বিদায় হয়েছিলো, সেই বিদায়ী ব্যাচের মর্মটা আমরা কখনো বুঝে উঠতে পারি নি। কিন্তু আজ যখন নিজে বিদায় নিলাম। তখন হাড়েহাড়ে বুঝতে পারলাম। বিদায় কী জিনিস! প্রাক্তন হওয়ার কী মর্ম। নিজের অজান্তেই মনটা জানি কেমন কেমন করছিলো। কোথায় যেনো লুকানো চিনচিনে একটা ব্যথা ? ঠিক কাউকে বোঝানো যাবে না, কেমন লাগছে। বারবার ভাবছি আমাদের বিদায় হচ্ছে। সত্যি-ই কী রসায়ন বিভাগ আমাদের বিদায় দিচ্ছে। বিদায় কেনো দেবে? এটা তো আমার, আমাদেরই পরিবার। পরিবার থেকে কেউ কখনো একেবারে বিদায় নেয় না, কেউ বিদায় হয় না। এ কথা স্যারেরা অনেকবার বললো, রসায়ন বিভাগ হতে তোমাদের ঠিক বিদায় নয়। তোমাদের সাথে আমাদের বন্ধন অটুট থাকবে। হয়তো ছাত্র হিশেবে নয়। রসায়ন বিভাগ তো তোমাদেরই বিভাগ। তবুও বাস্তবতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে মানাতেই খুব কষ্ট হচ্ছিলো। একেবারে বিদায় না হলেও আনুষ্ঠানিক প্রস্থান তো হচ্ছে। ঠিক যেভাবে একদিন আমাদের নবীন বরন হয়েছিলো।

Post MIddle

জগতের এটাই তো নিয়ম। পুরাতনরা জায়গা ছেড়ে দেবে, নতুনরা গ্রহন করবে। বিদায়ের কথা মনে পড়তেই বারবার অবুঝ মনটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আরে আমাদের ভালোর জন্যই তো বিদায় হচ্ছে। মাঝেমাঝে ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বৃহৎ স্বার্থ পরিত্যাগ করতে হয়। যা হচ্ছে আমাদের ভালোর জন্যই হচ্ছে। আরেকবার হঠাৎ মনেহচ্ছে। আজ বিদায়ের দিনে তো আমার মন খারাপ করার কথা নয়। সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ার থাকতে কতবার ভেবেছি। এখনো অনার্স, মাস্টার্স শেষ হয় না কেনো? এতো বছর লাগে। শেষ হলেই তো বাঁচি, এখান থেকে চলে যেতে পারি। ভালো চাকরি করবো, টাকা উপার্জন করবো। আরো কতো কী? কিন্তু আজ বিদায়ের দিনে বুঝলাম নবীন হিসেবে বরন হওয়া যতো সহজ, বিদায় নেওয়া ততো সহজ নয়। অনেক বেশিই কঠিন।

যেদিন নবীন ছিলাম স্যারের সেদিন অনেক অনেক সদুপদেশ দিয়েছিলো, অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলো। কিছুকথা স্বভাবের দোষে নীতিকথা বলে উড়িয়ে দিয়েছি। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা সেই প্রথম থেকেই বারবার বলেছিলো নিয়মিত ক্লাশ করবে, পরিক্ষা দেবে, এক্সট্রাকারিকুলাম এক্টিভিটিজ করবে, লাইব্রেরীতে যাবে, পড়াশুনা করবে ভালোভাবে। সর্বোপরি ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবে। যতটা পারো জ্ঞান অর্জন করবে। ভার্সিটি জীবনে শিক্ষকদের কোনো কথা মাথায় ঢুকেছে আবার কোনোটা মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। যেগুলো মাথায় ঢুকেছে সেগুলো হয়তো মেনেচলার চেষ্টা করেছি কিন্তু যেগুলো মাথার উপর দিয়ে গেছে। সেগুলোর জন্য খুব করুণা হচ্ছে।

আজ বারবার মনেহচ্ছে সেগুলো শুনলে হয়তো খারাপ হতো না, ভালোই হতো। ভার্সিটিতে লেখাপড়ায় কখনো সিরিয়াস ছিলাম না কিন্তু কেনো সিরিয়াস হলাম না? বিদায় বেলায় এ প্রশ্নের উত্তর আর আমার জানা নেই। ভাবতেই খারাপ লাগছে। তবে সিরিয়াস স্টুডেন্ট না হলেও এ কথা বুঝতে পারছি। ভার্সিটি হলো শেখার জায়গা, নিজেকে মানুষ হিশেবে তৈরি করার প্লার্টফর্ম। আজ মনেহচ্ছে এতোবছর ভার্সিটিতে থেকে জীবনের কিছুই শেখা হলো না, আরো অনেক কিছু শেখার বাকি রয়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষনেই কেমন জানি মনেহলো। যা শিখেছি, জেনেছি সেটা খুব কম হলেও অভিজ্ঞতার ঝুলিটা একেবারে কম নয়। যেটুকু শিখেছি সেটাই বা কম কিসে? যে যাই বলুক ভার্সিটিতে আসল মজা ক্লাশেই, শেখার জায়গা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। নিজেকে প্রশ্ন করলে এ কথা বলতে পারি, ক্লাশ যতটা পেরেছি করেছি কিন্তু মনেহচ্ছে আরো কিছু ক্লাশ করলে কী খুব খারাপ হতো।

শিক্ষকদের কাছে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই সমান। আমরাই নিজেরা নিজেদের দুরে সরিয়ে রাখি। রসায়ন বিভাগে আমরা পেয়েছিলাম এক ঝাঁক শ্রদ্ধাভাজন গুণীশিক্ষক। তারা আমাদের অনেক কিছুই শেখাতে চেয়েছিলেন, উজাড় করে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমরাই অনেকসময় জানতে, শিখতে অনাগ্রহ, অনীহা প্রকাশ করেছি। আমরা নিজেরা নিজেদের শেখার জন্য উজাড় করে দিতে পারি নি। এ ব্যর্থতা আমাদের। রসায়ন বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা বরাবর আমাদের পাশে ছিলেন, আমাদের সবসময় ভালো চেয়েছেন কিন্তু একজন ছাত্র হিশেবে এই জিনিসটা বুঝতে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। যখন বুঝেছি তখন হাতে আর বেশি সময় ছিলো না।

এ কথা জানি রসায়ন বিভাগের এতোএতো ছাত্রছাত্রীর মাঝে শিক্ষকদের কাছে আমি মনেরাখার মতো কোনো ছাত্র নই। তবে এতো কথা কেনো বলছি, তাও ঠিক জানি না। তবে এতোটকু বঝুতে পারছি। রসায়ন বিভাগের সাথে কেমন করে যেনো এই সুদীর্ঘ সময়ে একটু একটু করে জড়িয়ে গেছি। নিজের অজান্তেই একটা ভাললাগা, ভালবাসা তৈরি হয়ে গেছে রসায়ন বিভাগের সাথে কিন্তু আগে কখনোই তা বুঝে উঠতে পারি নি। যেখানে থাকুক ভালো থাকুক শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকরা। ভালো থাকুক প্রাণপ্রিয় রসায়ন বিভাগ। ভালো থাকুক স্নেহের ছোটভাই ও বন্ধুরা। আজীবন অটুট থাকুক রসায়নের বন্ধন কারন এ গল্পটা যে আমাদেরই।। লেখা : শামসুজ্জোহা বিপ্লব

পছন্দের আরো পোস্ট