পাহাড়ের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় আশার আলো ”পাড়াকেন্দ্র ”

বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ যৌথ অর্থায়নে সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে পাহাড়ের দূর্গম ও সেবা বঞ্চিত এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর কাজ করে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পাড়া কেন্দ্র। এযাবত পাড়া কেন্দ্রে ১ লক্ষ ৫২ হাজার শিশু প্রাক- প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণসহ ১৯টি যোগ্যতা অর্জন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝড়ে পড়া হার কমছে পার্বত্য এলাকায়। পার্বত্যাঞ্চলের মা ও শিশুদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষে আশির দশকের গোড়ার দিকে তিন পার্বত্য জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ও ইউনিসেফের সহায়তায় শিশু শিক্ষা,উন্নয়ন,স্বাস্থ্য,পুষ্টি পরিসেবা,পানি ও পয়:ব্যবস্থা এবং শিশু সুরক্ষার জন্য পাড়া কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু করে। তবে পুরোদমে শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। বর্তমানে এই প্রকল্প বিস্তৃতি লাভ করেছে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলার ১১৭টি ইউনিয়নের ৩৬১৬টি গ্রামে।

pahariদূর্গম পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত ৪ থেকে ৬ বছরে ১০ থেকে ৩০ জন শিশু নিয়ে একটি পাড়াকেন্দ্র গড়ে উঠে। প্রতিটি পাড়া কেন্দ্রে একজন পাড়াকর্মী প্রতিদিন দুই ঘন্টা সপ্তাহে ছয় দিন পাঠদান করেন। পাড়াকেন্দ্রে সর্বোচ্চ তিন বছর প্রাক-শিক্ষা দিয়ে শিশুর বয়স ৬ বছর পূর্ণ হলে পাড়াকর্মী নিজ উদ্যোগে ঐ শিশুকে নিকটস্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহযোগিতা করে থাকেন।

শিশুদের নাচ-গান,খেলাধুলা,ছড়াসহ অক্ষর জ্ঞান দান করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভর্তি সুযোগ করে দেয়া হয়। তাছাড়া মায়েদের স্বাস্থ্য বিষয়েও সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে মা ও শিশুর উন্নয়ন এবং সর্বোপরি নারী ও শিশুদের অধিকার সংরক্ষনে কাজ করা হয়ে থাকে।

সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ জানে আলম জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে সেবা প্রদান ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, শিশু শিক্ষা ও প্রাক শৈশব উন্নয়ন,স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়ন, শিশু সুরক্ষা, পানি ও পয়ঃ ব্যবস্থা উন্নয়ন, উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ, কম্যুনিটি সক্ষমতা উন্নয়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন, ৩-৫ বছর বয়সী সকল শিশুকে পাড়াকেন্দ্রে প্রাক শিক্ষা দান, পাড়াকেন্দ্রর ১০০% শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিকরণ, প্যারেন্টিং এডুকেশান কর্মসূচী বাস্তবায়ন,পাড়াকর্মী প্রশিক্ষণ, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, মা ও শিশুদের ঠিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ,প্রসূতি মা-দের জন্য ভিটামিন ‘এ’ বিতরণ, শিশু ও কিশোরীদের জন্য ক্রিমিনাশক বড়ি বিতরণ,শিশুদের জন্য ভিটামিন মিনারেল পাউডার বিতরণ, পুষ্টি শিক্ষা কার্যক্রম,অপুষ্টির মাত্রা পরিমাপ ও ব্যবস্থাপনা, জন্ম নিবন্ধীকরণ, সুরক্ষা বার্তা প্রচারনা,কিশোরী সহায়তা কার্যক্রম, সবুজ পাড়া কর্মসূচী, জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি, উন্নয়নের জন্য ক্রীড়া, দুস্থ শিশুদের সহায়তা,নলকুপ স্থাপন ও সংস্কার,স্বল্পব্যয়ী স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা সরবরাহ, কেয়ার টেকার প্রশিক্ষণ ও টুলবক্স বিতরণ, পরিবার পরিদর্শন, উঠান বৈঠক আয়োজন,জীবন নির্বাহী জরুরী বার্তা প্রচারণা, নাটক মঞ্চায়ন,বিল বোর্ড স্থাপন, স্বাস্থ্য তথ্য স্থানীয় ভাষায় ভাষান্তর, কুম্যনিটি তথ্য ব্যবস্থাপনা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদ্যাপন,পিসিএমসি সদস্যদের প্রশিক্ষণ, কর্মশালা আয়োজন,কম্যুনিটি শপ, আয়বর্ধকমূলক কার্যক্রম ও পাড়া তহবিল গঠন, সার্ভিস ম্যাপিং কার্যক্রম, বেইজ লাইন ও এন্ড লাইন সার্ভে, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্যায়ন, বিভিন্ন পর্যায়ে মনিটরিং সভা, ডকুমেন্টেশান, পাড়া কেন্দ্রভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও অন্যান্য সেবা প্রদান কার্যক্রম জোরদার করা লক্ষ্যে ৪০০ টি পাড়াকেন্দ্র রিসোর্স সেন্টার হিসাবে গড়ে তোলা প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

pahari.jpg1তাছাড়া পাড়াকেন্দ্রর সাথে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার সম্পৃক্ততা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পটি জেলা পরিষদগুলোর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানগণ সমন্বয় কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়মিত মনিটর করেন। জেলা পরিষদে এ প্রকল্পের একটি লিঁয়াজো অফিস স্থাপন করে ১জন কো-অর্ডিনেটর, ৪জন প্রোগ্রাম অফিসার, ১জন হিসাব সহকারী, ১জন কম্পিউটার অপারেটর, ১জন এমএলএসএস ও ১জন ড্রাইভারকে পদায়ন করা হয়েছে ।

Post MIddle

প্রকল্পের এ পর্যন্ত উল্লে¬খযোগ্য অর্জন গুলোর মধ্যে রয়েছে পাড়াকেন্দ্র সেবা, প্রশিক্ষন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি মান উন্নয়ন, শিশু সুরক্ষা, পানি ও পয়ঃ ব্যবস্থার উন্নয়ন , আবাসিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সহায়তাদান।

প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত পাড়াকেন্দ্র সমূহ প্রকল্পের উপকার ভোগীদের মধ্যে বিভিন্ন মৌল সেবা বিতরণের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। শিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, পুষ্টি উন্নয়ন, রক্ত স্বল্পতা প্রতিরোধ, বিশুদ্ধ পানি সরবাহ, পয়ঃ ব্যবস্থা উন্নয়নসহ জীবন ধারণের জন্য যথোপয্ক্তু আচরনে অভ্যস্থ করতে পাড়াকেন্দ্র সমূহ ভুমিকা রাখছে। সামাজিক উন্নয়নে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে পাড়াকর্মীগনকে মৌলিক ও সঞ্জিবনী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রকল্পে বর্তমানে ৩৫০০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাড়াকর্মী কর্মরত আছেন। চলতি অর্থ বছরে ৩০০ জন পাড়া কর্মীর মৌলিক প্রশিক্ষন, ৫০০ পাড়াকর্মীর অনজব প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়েছে, ৩৩৬ জন সিনিয়র পাড়াকর্মী নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত ৩-৫ বছর বয়সী শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুতকরনের লক্ষ্যে পাড়াকেন্দ্রে ২ বছর মেয়াদী শিশু বিকাশ ও প্রাক-শিক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে শিশু বান্ধব পরিবেশে হেসে-খেলে-নেচে-গেয়ে শিশুরা বর্ণমালা, অংকের ধারনা, চারুও কারু এবং পরিবেশ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে। পাড়াকেন্দ্র উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিকটস্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে পাড়া কেন্দ্র গুলোতে ৬২,২২২ জন শিশু প্রি-স্কুলে অধ্যয়নরত আছে। চলতি বছর প্রি-স্কুল উত্তীর্ণ ১৭,৫২৫ জন ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রতিরোধ যোগ্য রোগের সংক্রমন হ্রাস এবং এনিমিয়া প্রতিরোধের লক্ষ্যে চলতি বছর ৫১৬৯ জন শিশু, ১৮,৪০৫ জন মহিলা ও ১৮৪২ জন গর্ভবর্তী মহিলাকে টিকা গ্রহনে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে । এছাড়া ৫৫৮ জন প্রকল্প কর্মকর্তা কর্মচারীকে প্রত্যক্ষ পুষ্টি সহায়তা (ডিএনআই) বিষয়ক প্রশিক্ষণ দান ও ২৫২০টি পাাড়া কেন্দ্রে আয়রন ট্যাবলেট, ভিটামিন মিনারেল পাউডার বিতরন করা হয়েছে। চলতি বছর ৩৩০ টি পাড়া কেন্দ্রে শিশু সুরক্ষা বিষয়ক কার্যক্রমের আওতায় উদ্দীষ্ট জনগোষ্টির ১০০% জন্ম নিবন্ধন, কিশোরীদের জীবন নির্বাহী সক্ষমতা সৃজন এবং শিশু অধিকার বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি বিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ বছর ৮০ টি পাড়া কেন্দ্রে হ্যান্ড ওয়াচিং স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা হয়েছে, ২৫০০ সেট স্বল্প ব্যয়ী লেট্রিন বিতরন এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানি পান, স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহার ও হাইজিন প্রমোশন মূলক উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ক্ষুদ্র ও পশ্চাদপদ নৃগোষ্ঠির মধ্যে শিক্ষা সম্প্রসারনের জন্য ৪টি আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। ম্রো, খুমী, খিয়াং, ত্রিপুরা, মারমা, বম সম্প্রদায়ের ১০০ জন শিক্ষার্থী খাদ্য, আবাসন, পোশাক পরিচ্ছদ, শিক্ষা উপকরণ বিনা মূল্যে প্রাপ্তিসহ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করছে। এসব বিদ্যালয় থেকে এ পর্যন্ত ৪৮৭ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পাশ করেছে।

প্রকল্পটি তিন জেলায় শতভাগ কভারেজ হলে পার্বত্য এলাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালে জুন মাস পর্যন্ত সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প ৩য় পর্যায়ের কার্যক্রম চলমান থাকবে বলে জানা গেছে।

এদিকে পাড়াকেন্দ্র ভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের স্ব-স্ব মাতৃভাষার বর্ণমালাগুলো পরিচিতিকরণ, মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং সহ যেসকল জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে সেগুলোকেও পাড়াকেন্দ্র ভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় অর্ন্তভুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকার সচেতন মানুষ। এ সকল জাতিসত্তার স্ব-স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি এসব পাড়া কেন্দ্র ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সহজ হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পছন্দের আরো পোস্ট