ড. মানিক লাল দেওয়ানের গ্রন্থ ‘আমি ও আমার পৃথিবী’

‘আমি ও আমার পৃথিবী’, ড. মানিক লাল দেওয়ানের গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন দীপিকা দেওয়ান। প্রচ্ছদ এঁকেছেন অরুনেন্দু ত্রিপুরা। গ্রন্থটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে দুই শত টাকা। এটি একটি আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ। গ্রন্থাকার ড. মানিক লাল দেওয়ানের আত্মজীবনী এখানে তুলে ধরা হয়েছে। পেশাগত জীবনে ড. মানিক লাল দেওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছাড়াও পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে তিনি ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। গ্রন্থটির ভূমিকা কথনে অধ্যাপক ড. মানিক লাল দেওয়ান জানিয়েছেন যে, তিনি স্বপ্রণোদিতভাবে এ গ্রন্থ রচনা করেছেন।

এ গ্রন্থে অধ্যায় রয়েছে বাইশটি। প্রতিটি অধ্যায়ে গ্রন্থাকারের জীবনকালের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে গ্রন্থাকার তাঁর জন্ম ও ছেলেবেলা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে কিশোরকাল, তৃতীয় অধ্যায়ে পাকিস্তান অন্তর্ভূক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চতুর্থ অধ্যায়ে স্বদেশে উচ্চশিক্ষা, পঞ্চম অধ্যায়ে বিবাহ ও পরিবার, ষষ্ঠ অধ্যায়ে প্রথম চাকরি, সপ্তম অধ্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজে শিক্ষকতা, অষ্টম অধ্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা, নবম অধ্যায়ে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ঘরে ফেরা, দশম অধ্যায়ে কাপ্তাই লেক ও পরবর্তী পরিবেশ, একাদশ অধ্যায়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে চাকরির নানা দিক, দ্বাদশ অধ্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে উচ্চশিক্ষা, ত্রয়োদশ অধ্যায়ে মুিক্তযুদ্ধ ও যুদ্ধ উত্তর পরিস্থিতি ও লেখকের উদ্বেগ, চতুর্থদশ অধ্যায়ে মস্কো থেকে ঘরে ফেরা, পঞ্চদশ অধ্যায়ে ব্রিটেনে পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপে উচ্চতর গবেষণা কর্মকান্ড, ষোড়শ অধ্যায়ে ইরাকে অধ্যাপনা, সতের অধ্যায়ে ভারত ও শ্রীলংকায় ভ্রমন বিষয়ক অভিজ্ঞতা বিবরণ, আঠারতম অধ্যায়ে সুপ্রতিবেশি ও সুপ্রতিবেশির প্রয়োজনীয়তা, ঊনিশতম অধ্যায়ে রাঙামাটি পাবর্ত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তি ও দায়িত্ব পালন, বিশতম অধ্যায়ে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা, একুশতম অধ্যায়ে চাকরিকালে নানা কাজের স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা অর্জন এবং বাইশতম অধ্যায়ে নিজের সম্পৃক্ততা সম্বলিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ফটো এ্যালবাম সংযুক্ত করা হয়েছে।

ড. মানিকলাল দেওয়ানের জন্ম ১৯৩২ সালের ৫ জানুয়ারী পার্বত্য রাঙ্গাঁমাটি জেলার চাকমা পরিবারে । এক সময়ের অনুগ্রসর ও পশ্চাদপদ জনপদ থেকে অনেক প্রতিকুলতা জয় করে আলোর পথে এগিয়ে এসেছেন। দূর্গম উপজাতি জনপদ থেকে নানা দৈন্য-দশার মধ্যেও দেশে-দিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। বর্ণনা করেছেন দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে অধ্যাপনা করার অভিজ্ঞতাও।

ড. মানিক লাল মনে করেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমেই জাতীয় সংসদে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ কার্যকর করা, বিশিষ্ট এবং অরাজনৈতিক, পন্ডিত ও বরেণ্য ব্যক্তিকে উপাচার্য নিয়োগ এবং এ সম্পর্কিত বিষয়ে তাঁর ভাবনা তুলে ধরেছেন। তিনি পাহাড়ীদের শিক্ষার উন্নয়ন, শান্তি চুক্তি এবং পাহাড়ী-বাঙালী মিলে মিশে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন দিক উল্লেখ করেছেন।

Post MIddle

গ্রন্থে আদিবাসী নারীদের সংসার কর্ম উল্লেখ করতে গিয়ে ড. মানিক লাল দেওয়ান গারো সমাজে নারীর কর্মকময় জীবন তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, একজন নকনা যেমন তার দায়িত্ব পালনে অনুগত তেমনি গারো নারীরা তাদের দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল। গারো নারীরা কাজ করেন ঘরে, মাঠে এবং হাট বাজারে। ঘরের কাজ সামাল দিয়ে কখনও কখনও পশরা সাজিয়ে বসেন হাটে বাজারে। পণ্য বেচা কেনায়ও গারো নারীরা বেশ পারদর্শী।

এক্ষেত্রেও তারা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশী আন্তরিক ও সচেতন। ক্ষেতে খামারে উৎপাদিত শস্য নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারা বাজারে নিয়ে আসে। দূরের কোনো এক হাটের গন্তব্যে যেতেও তারা অলসতা নেই। গৃহকাজে ব্যবহার্য্য পণ্য সামগ্রী, হাতে তৈরী জিনিসপত্র, হাঁস-মুরগী, লাকড়ি সহ নানা প্রকার জিনিষপত্র নিয়ে আসেন বাজারে। কখনও কখনও বেচা কেনার ফাকে নিজেরা আলাপ চারিতায় মগ্ন হয়ে পড়ে।

আমি ও আমার পৃথিবীএভাবেই কাজের ফাকে ক্লান্তি নিরসনের চেষ্টা করে গারো নারী। গারোদের কৃষি কাজে নারীর বিশিষ্টতা রয়েছে। তাদের কৃষির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীর উপস্থিতি বিদ্যমান। কখন কোন ফসল উৎপাদন করতে হবে এবং কখন কোন বীজ বুনতে হবে তা নারীরাই নিরূবলে করে থাকেন যা তাদের দেবতা কুমারী থেকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।

গারো নারীরা তাদের ধৈর্য্যের পরিশ্রম দিয়ে এখনও তাদের বিশেষ কৃষি কৌশল ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে। নারীরা সন্তানকে কোলে পিঠে বেধে রেখে মাঠে কাজ করে যা বিরল দৃষ্টান্ত। তারা একদিকে যেমন ঘরে কাজ করে, সন্তান লালন পালন করে আবার সমানভাবে মাঠে কাজ করে। পুরুষেরা কখনও কখনও অলস জীবন যাপন করলেও গারো নারীদের যেন ক্লান্তি ছুতে পারে না। পরিয়ার পরিচালনা করা, সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ এবং মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নানা পন্থা নির্ণয়ে গারী নারী বিশিষ্ট। বিভিন্ন অফিস আদালতে, কুটির শিল্প, এনজিও, নানাবিধ উন্নয়নমূলক ও সেবামুখী কর্মকান্ডে গারো নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সমাজ ও অর্থগতিতে তাদের ভূমিকা অসাধারণ রয়েছে।

ড. মানিক লাল দেওয়ান রচিত গ্রন্থটি তাঁর আত্মজীবনীমূলক হলেও এ গ্রন্থ পাঠে অনঅগ্রসর জাতিগোষ্ঠির যাপিত জীবন, আদিবাসী জাতি গোষ্ঠির উঠে আসা এবং তাদের কর্ম অভিজ্ঞতার নানা বিষয়ে পাঠক অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠিকে জানার ক্ষেত্রে গ্রন্থটি সুখপাঠ্য।

পছন্দের আরো পোস্ট