সাগরকন্যা কুয়াকাটায় উত্তাল তারুণ্য

`স্মৃতি তুমি অাছো বলে বেঁচে
অাছি অামি
চোখে অামার রবির কিরণ, অাঁধার
অস্তগামী।’

Post MIddle

স্মৃতিকে অাঁকড়ে ধরে মানুষের বেঁচে থাকা, পথচলা সম্মুখে দিগন্তের সূর্যের অালোকে চক্ষুপাত করে। দুর্বিষহ জীবনে একমুঠো স্বস্তির প্রসাদ লাভ করার জন্য, একফালি অমৃতে তার অবয়বকে রাঙানোর জন্য মানুষের স্বপ্নবিলাসী মন স্বপ্ন দেখে, ভ্রমণপিপাসায় পিপাসার্ত হৃদয় ছুটে যেতে যায় কোনো এক বাঁধনহারা নিভৃত কুঞ্জে… সালটি ২০১৬, ২৫-২৭শে মার্চ। লিখতে বসেছি বশেমুরবিপ্রবি’র বাংলা পরিবারের কুয়াকাটা ভ্রমণের সারসংক্ষেপ। অনেকদিন ধরে লিখব লিখব করে কিছুই লেখা হয়ে উঠেনা। তবু অাজ অামি লিখব… স্মৃতি পঞ্জিকায় গেঁথে রাখব সেঁদিনের কথা, হাঁসি-কান্না কিংবা দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা।

458329

২৫ শে মার্চ, রাত প্রায় সোয়া ১১টা বাজে তখন। অামরা সকলে ভ্রমণের টি-শার্ট পরিধান করে বাসে উঠলাম। উদ্দেশ্য পটুয়াখালীর সাগরকন্যাখ্যাত কুয়াকাটাকে দু’পলক চোখ বুলিয়ে দেখার, বিধাতার অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যকে অস্তিত্বের মধ্যে ধারণ করা, অন্তরচক্ষু মেলে স্মৃতিকে জাপসে ধরা। সারা রাত্রি গান-বাজনা-অাড্ডার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলো। উল্লেখ্য যে, এই অানন্দ যাত্রায় অামাদের সঙ্গী হয়েছিলেন বাংলা বিভাগের বর্তমান শ্রদ্ধেয় সভাপতি অাব্দুর রহমান (সাগর) স্যার, প্রভাষক মুমতাহানা মৌ ও জাকিয়া সুলতানা মুক্তা ম্যাম। বাস ছিলো দু’টি। অামাদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের প্রায় ৮০ জন শিক্ষার্থীর গন্তব্যস্থান এখন কুয়াকাটা, নজর সকলের কুয়াকাটার পানে দৃষ্টিবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে বাস ছাড়তে ছাড়তে সময় হলো প্রায় ১১ বেজে ২০ মিনিট।

এক অন্যরকম নির্ঘুম রাত্রির অবসানে সকাল প্রায় সাড়ে ৭টায় পৌঁছালাম অামরা অামাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থানে। সেখানে পৌঁছে সকলে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে হোঁটেলে সেরে ফেললাম সকালের নাস্তা রুটি-ডিম ভাজি, সাথে সামান্য তরকারি। তারপর অামাদের উৎসুক দৃষ্টি শুধুমাত্র সাগরকন্যার পানেই, কখন অামরা যাব সেখানে, কখন দু’চোখ ভরে না হয় দু’পলক দেখব নৈসর্গিকতার নয়নাভিরাম লীলাভূমি সাগরকন্যার রূপময়তাকে। এই প্রত্যাশায় অামরা সকলে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, অধীর অাগ্রহে অানচান প্রাণ বুকের মধ্যেই এতক্ষণে যেনো অন্য এক কুয়াকাটা অাবিষ্কার করে ফেলেছিলো। এরপর সকল অাগ্রহের পরিত্রাণ ঘটিয়ে অামাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো কুয়াকাটার মাতাল যৌবনের দিকেই। তবে এসেই যখন ফেলেছি এখানে, অার অপেক্ষা কি! ঝাঁপিয়ে পড়লাম সাগরকন্যার বুকে। শুরু হলো বাঁধভাঙা সাগরের যৌবনে মাতামাতি অার নাঁচানাঁচি। উত্তাল তারুণ্য যেনো সাগরের মাতাল যৌবনে মিশে একাকার হয়ে গেলো। মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণখানি—

`হৃদয় অামার নাঁচেরে অাজিকে
ময়ূরের মতো নাঁচেরে।’

কেউ করছে তরঙ্গের স্রোতের সঙ্গে নৃত্য, কেউ-বা দলবেঁধে লাফাচ্ছে জলভরা সাগরের উদ্দাম যৌবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কেউ একা, কেউ-বা দলবেঁধে। এভাবে ঝাঁপাতে ঝাঁপাতে অার লাফাতে লাফাতে বেজে গেলো দুপুর প্রায় দেড়টা। সাগরের অানন্দকে কিছুটা থামিয়ে অবরুদ্ধ করে অামরা রওনা হলাম হোঁটেলের উদ্দেশ্যে গোসল করে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুটা বিশ্রামের অাশায়। তবুও কি থেমে থাকে এই অপার অানন্দেরর হিল্লোল, বুকের মধ্যে যেই তারুণ্যের ঝড় বইছে তাকে অামরা দমাব কিভাবে!! যাই হোক, গোসল সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে সামান্য বিশ্রামে নিজেদের শরীরকে কিছুটা চাঙা করে এবার অামাদের যাত্রা হলো ওঁখানকার কিছু দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন ও কেনাকাটা করা।

স্থান পরিদর্শন শেষে অনিন্দ্যসুন্দর  প্রকৃতির সঙ্গে একাত্নতা ঘোষণা করে ওঁখানকারই কিছু দোকান থেকে অামরা অতি অল্প দামে কিনলাম অামাদের মনের মতো কিছু পোশাক, খাওয়ার অাচার কিংবা ভিন্নমাত্রিক শামুক-ঝিঁনুকের তৈরি নানা ধরণের সৌখিন সামগ্রী। গোধূলির অন্তিম ক্ষণে অাবারও ছুটে গেলাম অামরা সৈকতে সূর্যাস্তের অনুপম দৃশ্য মনোলোকে অবলোকন করার জন্য। এইভাবেই ধরণীর বুকে ঘনিয়ে অাসলো রাত্রি, তবে স্মৃতির বুকে তখনও অালোকরশ্মি সদা প্রজ্জ্বল ও দেদীপ্যমান। সেঁদিনের রাত্রির খাবার ছিলো একটু ব্যতিক্রম। জোয়ার মত্ত সৈকতের পাশে বসে রাত্রিতে খাওয়ার যে কি অানন্দ তা বর্ণনাতীত, নিজে উপলব্ধি না করলে বোঝানোর ভাষাটুকু জানা নেই অামার।

রাত্রিতে খেয়েছিলাম অামরা বার-বি-কিউ (গরুর পোঁড়ানো মাংস, সাথে পরোটা অালু ভাজি বার-বি-কিউ খাদ্যরূপে পরিচিত)। দু’তিনটি হোঁটেল বরাদ্দ করা হয়েছিলো অামাদের থাকার জন্য। গল্প-গুজবে ভরপুর রাত্রি যাপন শেষে স্নিগ্ধ প্রভাতের দীপ্তিতে ঘুম ভাঙলো অামাদের। তারপর অাবার হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে শেষদিনের মতো সাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া অার অব্যক্ত মাস্তি-ফূর্তিতে শরীক হওয়া। একটু সৈকতের তরঙ্গে নিজেদের তরঙ্গায়িত করে পায়ে হেঁটেই ঘুরতে গেলাম লেবুবন, কুয়াকাটায়। লেবুবনে কাটলো প্রায় এক ঘণ্টা মধুক্ষণ। অার ওঁখানে কাঁকড়া ভেজে খাওয়ার অানন্দটা তো ভ্রমণের অানন্দের মাত্রাটুকু বাড়িয়ে দিয়েছিলো অারও বহুগুণে। বলতে ভুলেই গেছি যে, সৈকত থেকে লেবুবন বেশ দূরে। বাইকে চড়ে অাসলে জন প্রতি গুণতে হয় ৬০ টাকা। তার মানে কতোদূর পথ যে অামরা হেঁটেই এসেছিলাম তা বোঝায় যাচ্ছে।

এরূপে ভ্রমণপিপাসায় কাতর অামাদের স্মৃতির হৃদয়গ্রাহী  মঞ্জিল থেকে বের হয়ে ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠলো। সময় বলে দিলো চলে যেতে হবে অামাদের। কিন্তু মাত্র দু’দিনে অামরা একে অপরের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। `ভ্রাতৃত্ব’ নামক শব্দটি অামাদের অাবদ্ধ করেছিলো স্মৃতিমল্লিকার একই বৃন্তে। অামার মনে হলো এই অল্প কিছু মুহূর্তে কুয়াকাটাও যেনো অামাদের অতি অাপন করে নিয়েছিলো, তাঁর অপূর্ব সৌন্দর্য্যের প্রগাঢ় বন্ধনে বেঁধেছিলো অামাদের হৃদয়খানি। তাইতো অামি কান পেতে শুনলাম সেঁ (কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত) যেনো চুপি চুপি বলছে—

`যেতে নাহি দিব, হায়,
তবু যেতে দিতে হয়
তবু চলে যায়।’

সাগরকন্যার মায়াবী বুকে স্মৃতিচিহ্ন গেঁথে দিয়ে অামরা যে যার মতো বাসে উঠলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরবার উদ্দেশ্যে। ফেরার পথেও ভ্রমণ হলো দু’টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল। অসাধারণ ক্যাম্পাসে মনোরম পরিবেশে নয়ন জুড়ে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় দু’টি।

unnamed

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অায়তনে ছোট হলেও রাত্রির গায়ে জ্বলা ল্যামপোস্টের ঝিকিমিকি অালোকে বিশ্ববিদ্যালয়টির অনাবিল সৌন্দর্য্য মুগ্ধ করেছিলো অামাদের সকলকে। এই সৌন্দর্য্যময়ীতাকে অাপন সত্ত্বায় বহন ও ধারণ করে অাবারও বাসে উঠলাম। বাসের মধ্যে কিছু খেয়ে গান-বাজনা-অানন্দ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলো অামাদের ভ্রমণ যাত্রা। গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছালো রাত্রি প্রায় ১২টার সময়ে। যারা হলে থাকে তারা হলের উদ্দেশ্যে নেমে গেলাে অার যারা শহরে মেসে থাকে তারা শহরে এসে নেমে পড়লো।

প্রত্যেকে প্রত্যেককে বিদায় জানিয়ে অাবারও প্রবেশ করলাম অামাদের কর্মময় একরকম একঘেঁয়েমি শিক্ষাক্ষেত্রে। তথাপি এই বিদায় যেনো শেষ বিদায় নয়, মহাকালের অমোঘ স্রোতে ভাসতে ভাসতে হয়তো কোনো একদিন ঠিকই পৌঁছে যাব ভিন্ন কোনো এক গন্তব্য স্থানে। হয়তো সেদিনের বিবর্ণ নীলাকাশে রংধনু জমবে না, মেঘের কোলে হাঁসবে না সূর্য; নয়তো-বা সেঁদিনের অাকাশটা হবে গাঢ় নীল, রংধনুর রক্তিম শোভায় শোভায়িত হবে অামাদের নেত্রদ্বয়, ঝিরিঝিরি সমীরণে মাথার চুল উড়াব অামরা, মিষ্টি প্রকৃতির মিষ্টতায় সিক্ত হব অাবারও, ভালোবাসতে শিখব অামার ভেতরের `অামি’- কে, নতুনভাবে বাঁচতে শিখব কোনো এক সুন্দরের সুদূর হাতছানিতে, ভালোবাসায় ভালোবাসায়  মুখরিত করব ক্ষণস্থায়ী এই জীবনটাকে, যৌবনের মুখরা উল্লাস ও উচ্ছ্বাসে ভাঙব সমস্ত শৃঙ্খল-বাধার বাঁধ।

দিন ফুরিয়ে গেলো, ধরণীর বুকে রাত্রি নামলো, তবু চোখে এখনও স্পষ্ট হয়ে অাছে ভ্রমণের ক’টি দিনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। যা ভোলা যায় না, ভুলতে পারবও না হয়তো কখনও।
`দিন যায় শেষ হয়ে, রাত নেমে অাসে
জীবনের বাঁকে তবু স্মৃতি হাঁসে,
তবু স্মৃতি হৃদ মাঝারে, বুঝিনা অামি কি সে!
স্মৃতি জাগায় শিহরণ, থাকে অস্তিত্বে মিশে।’

kuakata320160202152546

পছন্দের আরো পোস্ট