মাগো, তোমার কষ্ট হয় না, ক্লান্তি লাগে না?

Rimme Rummanকেন যেন সারা বছর সুস্থ থাকা আমি হুট করে কোন কারন ছাড়াই পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে যেতাম। শরীর পুড়ে যাওয়া জ্বর কিংবা হাত,পা বরফের মত শীতল। আম্মা বলতো, “সারা বছর ঠিকমত পড়স না ,এখন পরীক্ষার আগে টেনশনে অসুস্থ হইয়া যাস্‌!” এমন সব ভৎসনার মাঝে রাত জেগে চিলেকোঠার রুমে পড়তেই থাকি। আমার ক্লান্ত মা নির্ঘুম বসে থাকে সমস্ত রাত। ঝিমায়। কখনো বিদ্যুৎ চলে গেলে নিজে ঘেমে নেয়ে একাকার, তবুও আমায় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে।

 

আমি কোনদিন জানতে চাইনি, ” মা, তোমার গরম লাগে না, কিংবা হাত ব্যথা করে না ?” সকালে পরীক্ষার হলে যাবার আগে ছাদ থেকে তুলে আনা ফুল হাতে দিয়ে বলে, ফুল সাথে থাকলে মন ভাল থাকে। মন ভাল থাকলে, পরীক্ষা ভাল হয়। আমি সেই ফুল জ্যামিতিবক্সে ভরে পরীক্ষার হলে যাই। মন ভাল হয় কিনা, জানিনা।

 

শুধু জানি, পরীক্ষার সময়টুকুতে সেই চ্যাপ্টা হয়ে থাকা ফুল বেঞ্চির এক কোনায় পরে থাকে অবহেলায়। প্রথমপত্র পরীক্ষা শেষে টিফিন আওয়ারে আম্মা অফিস থেকে ছুটে আসে খাবার নিয়ে। আমি নোটবইয়ে চোখ বুলাই রুদ্ধশ্বাসে। আম্মা খাবার মুখে পুরে দেয়। দিতেই থাকে। দোয়া দরূদ পড়ে। মাথায় ফুঁ দেয়।

 

পরীক্ষা শেষে ক’দিন বাদেই নতুন উদ্দামে আবারো ছুটে চলা। কোন টিচারের কাছে কোন বিষয়গুলো প্রাইভেট পড়বো খোঁজ নিতে থাকে। সারাদিন অফিস শেষে সন্ধ্যায় নিজেই নোট লিখে দেয়। আমি বিনা কষ্টে সেই রেডি করা নোট পড়ি। পরীক্ষা দেই। কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি, ” মা, তোমার ক্লান্তি লাগে না, কষ্ট হয় না ?” জ্বরের সময়টাতে সেবা শুশ্রূষার মাঝেও নতুন জামা কিনে দিয়ে বলতো, নতুন জামা পড়লে মন ভাল হয়। মন ভাল থাকলে শরীর সুস্থ হয়ে উঠে তাড়াতাড়ি।

 

আমার মন ভাল হতো। সত্যিই অনেক ভাল বোধ হতো। কোনদিন বলিনি, “মা, তোমারও তো জ্বর হয়, তুমি নতুন শাড়ি কিনো না কেন ?” তিন ভাইবোনকে নিয়ে ঈদের কেনাকাটায় যেতো যখন, আমার দামী জামাটির দিকেই নজর লেগে থাকতো। আম্মা সরাসরি না বলতো না। শুধু বলতো, আচ্ছা আরেকটু ঘুরে দেখি। সাগরিকা কিংবা বিউটি স্টোরে নিয়ে গিয়ে দোকানদারকে নিচুস্বরে কিছু বলতো।

 

Post MIddle

অতঃপর ওঁরা যা দেখাতো আমার পছন্দ হতোনা কিছুতেই। আমার যে সেই নজর লেগে থাকা দামী জামাটাই চাই। মা মলিন মুখে শেষে তা-ই কিনে দিতেন। কোনদিন মনে হয়নি, এই জামাটি কিনে দিতে গিয়ে কতদিক দিয়ে কত বাজেট কাটছাঁট করতে হয়েছে ! যখন বড় হই, বিদেশে এসে জব করি। নিজের রোজগার। মা’কে কত কি দিতে মন চায় ! যা কিছু একসময় তাঁর সখ ছিল, সব স-ব। সোনার চুড়ি, সুন্দর সুন্দর শাড়ি। কিনেও দেই। আমার চিরকালের সৌখিন আম্মা লাজুক চোখে তাকায়। বলে, ” এইসবের কি দরকার ছিল, আমার এখন এইসব ব্যবহার করার বয়স আছে নাকি ?”

 

অতঃপর একসময় সকলের অগোচরে চুড়িগুলো হাতে দিয়ে দেখে। শাড়ি গায়ের সাথে জড়িয়ে দেখে। যেন পৃথিবীর সবচাইতে দামী জিনিষটাই এনে দিয়েছি ! আমার কোনদিন বলা হয়ে উঠেনি, “মা, ভালোবাসা দিতে দিতে তো নিঃস্ব হয়ে গেলা, সে তুলনায় তো তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি।” চারটি বছর কেটে গেলো মা ছাড়া এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমার। আরেকটিবার আমার মায়ের সন্তান হয়ে জন্মাবার তীব্র ইচ্ছে জাগে শুধু এই বলতে না পারা কথাগুলো বলবার জন্যে।

 

আমরা প্রায় সকলেই এমন। বেঁচে থাকাকালীন সময়ে এই বিষয়গুলোকে তুচ্ছ ভেবে এড়িয়ে যাই, তাই না ? আমার এই লেখাটি পড়ে যদি কোন সন্তানের মনের কোনে এতটুকু বোধ জন্মে যে ” তাই তো !” যদি কোন সন্তান তাঁর মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে, ” মাগো, তোমার কষ্ট হয় না, ক্লান্তি লাগে না ?”

 

তবেই আমার লেখার সার্থকতা। শুভকামনা সকল মা’কে…

 

রিমি রুম্মান নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

পছন্দের আরো পোস্ট