স্কুল গড়ার কারিগর নওয়াব আলী

১৯৬৮ সাল। কলেরা ও বসন্তের ছড়াছড়ি। আতঙ্কে মানুষ গ্রাম ছাড়ছে। এ সময় খাদ্য ও ওষুধ নিয়ে গ্রামের এক মা ও তাঁর ছেলে মানুষের পাশে দাঁড়ান। অনুরোধ করেন গ্রাম না ছাড়তে। তাঁদের কথা শুনে লোকজন বিদ্রূপ করেছিল। খেপে গিয়েছিলেন ছেলে নওয়াব আলী। মা খোদেজা বেগম তাঁকে শান্ত করে বলেছিলেন, শিক্ষার আলো না হলে গ্রামের মানুষজন সভ্যভব্য হবে না। শিক্ষার আলো গ্রামের সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।

মায়ের মুখে এ কথা শুনে অবাক হয়েছিলেন নওয়াব আলী। দিনের পর দিন সেটা ঘুরপাক খেয়েছে তাঁর মাথায়। একসময় ঠিক করেন, তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়বেন। সেখানে পড়াশোনা করবে এলাকার ছেলেমেয়েরা, হবে মানুষের মতো মানুষ।

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে নওয়াব আলীর বাড়ি। এলাকায় নিজে গড়ে তুলেছেন চারটি বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা। আরও তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মীয়স্বজনের কাউকে চাকরি দেননি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য নিজের জমি দান করে তৈরি করেছেন রাস্তা। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে সহায়তা করছেন। এলাকার সবাই তাঁকে চেনেন শিক্ষাপাগল মানুষ হিসেবে।

পড়ার জন্য নওয়াব আলীর কষ্ট
পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে হাজীপুর গ্রামে নওয়াব আলীর বাড়ি। তাঁর বয়স এখন ৮২ বছর। হাঁটেন লাঠিতে ভর দিয়ে। পাকা বাড়ি থাকলেও তিনি ঘুমান মাটির ঘরে। বয়সের ভারে এখন আগের মতো স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারেন না। তবে বসেও থাকেন না ঘরে। দিনে অন্তত একবার যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘুরে আসেন। ৭ সেপ্টেম্বর তাঁর বাড়িতে পৌঁছে প্রতিবেদক দেখেন সুনসান নীরবতা। কেউ নেই। খোঁজ করতেই একজন দেখিয়ে দেন, নওয়াব আলী স্কুলে যাচ্ছেন। যেতে যেতে তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হয়।

নওয়াব আলী জানান, আশপাশে তিন-চার মাইলের মধ্যে কোনো স্কুল ছিল না বলে দুই দফায় তাঁকে পড়াশোনা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তখন ব্রিটিশ আমল। গোটা এলাকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না। হেঁটে চলাচল করতে হতো। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন ভেন্ডাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টি ছিল পাঁচ মাইল দূরে। পাশের উপজেলা মিঠাপুকুরের বালুয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে এসএসসি পাস করেন।
একের পর এক স্কুল প্রতিষ্ঠা

১৯৭৪ সালে এলাকাবাসীর সঙ্গে মিলে নওয়াব আলী স্থাপন করেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এতে তিনি ৩৩ শতাংশ জমি দান করেন। নওয়াব আলী বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষকেরা নানাভাবে স্কুলটির উন্নতির চেষ্টা করতে লাগলেন। আমি গ্রামের প্রত্যেকের ঘরে ভিক্ষা চাইতে লাগলাম। কারও কাছে ধান, কারও কাছে মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে বিদ্যালয়ের ঘর তৈরি করলাম। সে সময়ের শিক্ষা কর্মকর্তাও বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। শিক্ষার্থীদের বই, পাকা ভবন হয়। নাম রাখা হয় হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’

এই স্কুলে এখন মোট ৩১৪ শিক্ষার্থী পড়ছে। এর মধ্যে ছাত্র সংখ্যা ১৪৩ এবং ছাত্রী ১৭১।

ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমজাদ বলেন, ‘নওয়াব আলীর কর্মকাণ্ড ব্যতিক্রম। তাঁর তুলনা হয় না। এখনো তিনি সপ্তাহে দুই দিন বিদ্যালয়ে এসে আমাদের কার্যক্রম তদারক করেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ আমাদের উজ্জীবিত করে। তিনি আমাকে নিয়োগ দিতে একটি পানও খাননি।’

১৯৯৪ সালে স্থাপিত হয় দানিশনগর উচ্চবিদ্যালয়। শুরুতে নিজের ২০ শতক জমি বিক্রি করে বিদ্যালয়ের তহবিলে ৫০ হাজার টাকা দেন নওয়াব আলী। বিদ্যালয়ের নামে লিখে দেন ১ একর ৫০ শতক জমি। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, স্কুলটি এমপিভুক্ত হওয়ার আগে টাকার অভাবে একজন আয়া বা পিয়ন রাখা সম্ভব হয়নি। তখন এটি পরিষ্কার রাখা ছিল বিরাট ঝামেলার কাজ। নওয়াব আলী স্বেচ্ছায় সেই দায়িত্ব নেন। তিনি প্রতিদিন স্কুলে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ নিতেন।
স্কুলের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা এবার ৩১৪, যার মধ্যে ১৯৬ জনই ছাত্রী।

ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোকছেদুর রহমান জানালেন, নওয়াব আলী ২২ বছর ধরে স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। অভিভাবকেরা প্রতিবার তাঁকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই পদে নির্বাচিত করেন।

নওয়াব আলীর বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে শাল্টি গ্রাম। ওই গ্রামের লোকজন চেষ্টা করেও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলেন না। জমি কে দেবে? জানতে পেরে নওয়াব আলী দান করেন সড়কের পাশের জমি। তাঁকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসেন আরও অনেকেই। কেউ টিন দেন, কেউ বাঁশ-কাঠ, কেউবা দেন টাকা। দাঁড়িয়ে যায় স্কুলটি। নাম রাখা হয় শাল্টি শমসদীঘি উচ্চবিদ্যালয়।

ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে এবার ৩০৭ শিক্ষার্থী। স্কুলের নামে ১ একর ৬ শতক জমি আছে। এর মধ্যে নওয়াব আলী ৫১ শতক জমি দিয়েছেন। এলাকাবাসী জানান, নওয়াব আলী ভূমিকা না নিলে এই স্কুল হতো না।

Post MIddle

ওই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম সভাপতি আফছার আলী বলেন, ‘নওয়াব আলী বিদ্যালয়ের নামে জমি লিখে দেবেন, ভাবতেই পারিনি। আমাকে একদিন বলেছিলেন শাল্টি গ্রামে একটি স্কুল হবে। আপনি হবেন তার সভাপতি। এত বড় ত্যাগ আমাদের সমাজে এ পর্যায়ের মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।’

এ ছাড়া শিক্ষার আলো ছড়াতে ১৯৯২ সালে দানিশনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৯৯৮ সালে হাজীপুর দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজ টাকা, অন্যদের সহায়তা ও নিজের দান করা জমিতে এ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। এ ছাড়া পীরেরহাট রহমনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, অনন্তরামপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও ঝাড়বিশলা হায়াতুল উলুম আলিম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছেন। এ তথ্য জানালেন প্রতিষ্ঠান দুটির শিক্ষকেরা।
শিশুদের কাছে স্বর্গ

পীরের হাট রহমনিয়া ফাজিল মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও চৈত্রকোল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান দেলদার হোসেন বলেন, নওয়াব আলী শিক্ষাপাগল মানুষ। তিনি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই গড়েননি, স্কুলে যাওয়া-আসার রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছেন। হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জোবেলা খাতুন বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যাওয়া-আসার জন্য দেড় একর জমির রাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন নওয়াব আলী।’

হাজীপুর দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আছিয়া খাতুন তার স্কুলব্যাগটি দেখিয়ে বলে, ‘নওয়াব দাদু কিনে দিয়েছেন। তিনি আমাকে বিনা টাকায় প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন।’

দানিশনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মতিন বলেন, ‘নওয়াব আলী চাচা শিশুদের কাছে স্বর্গ। বিদ্যালয়ে আসেন, শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন। বই-খাতা কিনে দেন। নিজ হাতে কক্ষের ময়লা-আবর্জনাও পরিষ্কার করেন।’

ওই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা বলে, ‘একদিন স্কুলে না আসলে পরের দিন বাড়িতে যান দাদু (নওয়াব আলী)।’ পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী হাফসা খাতুন বলে, ‘দাদু আমাদের বাবার মতো আদর করেন। কলম-খাতা, চকলেট কিনে দেন।’

বিনয়ী নওয়াব আলী
নওয়াব আলীর ছেলে মঞ্জুরুল হক জানান, নিজের সংসারের চেয়ে অন্যের উপকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন বলে এলাকার লোক তাঁর বাবাকে ছয়বার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিলেন।

তবে নওয়াব আলী বিনয়ী। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি ৩৩ একর জমির মালিক। চাকরি বা ব্যবসা করেন নি কোনোদিন। তিনি বলেন, ‘মানুষের জন্য তেমন কিছু করতে পারলাম না। শরীর কাঁপে, চলতে পারি না। আল্লাহ সুস্থ করে দিলে মানুষের জন্য আরও চেষ্টা করতাম কিছু করার।’

হাজীপুর গ্রামের সমাজসেবক মিজানুর রহমান বলেন, শৈশব থেকে মানুষের বিপদ-আপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন নওয়াব আলী। টাকা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে কায়িক শ্রম দিয়ে উপকার করতেন।

চৈত্রকোল ইউপির সদস্য মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘নওয়াব আলীকে নিয়ে আমরা খুব গর্ববোধ করি। তাঁর চেষ্টাতেই আজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত চৈত্রকোল ইউনিয়ন।’

উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, শেষ বয়সে এসেও নওয়াব আলী শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছেন। এমন নিঃস্বার্থ মানুষ সমাজে বিরল।

সুত্র : প্রথম আলো

পছন্দের আরো পোস্ট