যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেন শিক্ষকরা

বাংলাদেশের মায়েরা সন্তানদের পড়াশোনা, ভালো স্কুল, ভালো ফলাফলের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন বলে জানি। আমার এক বন্ধু, যে সারাদিন বাসায় থাকে না। স্কুল ছুটি শেষে মেয়েকে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে বেইলি রোডের দিকে কোচিং এর উদ্দেশ্যে। তাঁর ভাষায় ওইদিকে সব ভালো শিক্ষকদের বসবাস। দু’টো কোচিং শেষ হতেই সন্ধ্যা নামে। তাঁরা কয়েকজন মা মিলে আশেপাশেই একটি রুম ভাড়া নিয়েছে, যেখানে বিশ্রাম নেয়া, খাওয়া, নামাজ সহ প্রয়োজনীয় কাজ সারেন।
পড়া শেষে সন্তানদের নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরে যখন, ততক্ষনে দিনের আলো মিলিয়ে নিয়নের কমলা আলোয় ঢেকে থাকে ঢাকা শহর। এমন করেই সন্তানদের ঘিরে ব্যস্ততায় সকালের প্রথম প্রহর দুপুরে গড়ায়, বিকেল পেরিয়ে রাত্রি নামে রোজ। দেশে বেড়াতে গেলে আমার স্বজন, বন্ধুরা কেউ কেউ বলে, ” তোমাদের তো এতো পরিশ্রম করতে হয়না, স্কুলেই সব পড়া কমপ্লিট করিয়ে দেয় “। সত্যি বলতে কি দেশে থাকতে বিদেশের লেখাপড়া সম্পর্কে আমি নিজেও এমন ধারনা পোষণ করতাম। কিন্তু ধারনাটি পুরোপুরি সঠিক নয়।
আমার ছেলে রিয়াসাত স্কুল জীবনের শুরুতে পরপর তিন বছর একই সহপাঠীদের সাথে পড়েছে। আচ্‌মকা থার্ড গ্রেডে তাঁকে ভিন্ন একটি ক্লাসে দেয়া হয়। কেননা, বিগত ক্লাসে তাঁরা দুই বন্ধু শতভাগ নাম্বার পাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় লেগে থাকতো। একজন এক’শ পেলে খুশিতে বাড়ির দিকে হেঁটে যেতো। অন্যজন না পেলে মনখারাপের মাঝে অশ্রুজলে ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরতো। ব্যপারগুলো শ্রেণী শিক্ষকের নজর এড়ায়নি। বললেন, বিষয়টি শিশুমনের উপর একরকম চাপ সৃষ্টি করে, বিধায় ভিন্নক্লাসে দেয়া। নতুন ক্লাস, নতুন সহপাঠী সম্ভবত তাঁর মনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া সেই ক্লাসে প্রতিযোগিতাও ছিল না। ফলে ক্রমেই সে খারাপ ফলাফল করতে লাগলো।
আগের ক্লাসে যেসব বিষয়ে ৯৮/১০০ পেতো, সেসব বিষয়ে ৯০/৯২ পেলো। আমরা শ্রেণী শিক্ষকের সাথে সাক্ষাতে উদ্বেগের কথা জানালাম। ক্লাসে রিয়াসাতের দিকে আরেকটু মনোযোগ দেবার অনুরোধ জানালাম। শিক্ষক একরকম বিরক্তি নিয়েই জানালেন, ” তোমার সন্তান ৯০+ নাম্বার পাচ্ছে। যেসব শিক্ষার্থী ৭০ এর নিচে নাম্বার পাচ্ছে, আমাদের উদ্বেগ, মনোযোগ তাঁদের দিকে। আমরা তাঁদের এগিয়ে নেবার জন্যে পরিশ্রম করছি “।
সেদিন উপলব্ধি করলাম, এদেশে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষকরা কঠোর পরিশ্রম করেন। তাঁদের জন্যে আফটার স্কুল, সামার প্রোগ্রামসহ নানারকম মান উন্নয়নমূলক কর্মসূচি থাকে। কিন্তু মোটামুটিভাবে এগিয়ে থাকা ছাত্রদের আরো ভালো ফলাফলের জন্যে অবিভাবকদেরই চেষ্টা করতে হয়। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভালো স্কুলগুলোয় সুযোগ পেতে বাধ্য হয়েই কোচিং সেন্টারের দিকে ছুটতে হয়। স্পেশালাইজড স্কুলগুলোয় প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে থাকে। মেধানুযায়ী যে ৩ হাজার ছাত্রছাত্রী সুযোগ পেয়ে থাকে, তাঁদের বেশিরভাগই এশিয়ান। বিশেষকরে চায়নিজ, জাপানিজ, ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশী।
যদিও নিউইয়র্ক সিটির মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্প্যানিক। অথচ মাত্র চারভাগ কৃষ্ণাঙ্গ ও ছয়ভাগ হিস্প্যানিক ছাত্রছাত্রী এসব স্কুলে সুযোগ পেয়ে থাকে। এবছর যে নয়’শ জনের কিছু বেশি Stuyvesant হাই স্কুলে সুযোগ পেয়েছে, এরমধ্যে প্রায় ছয়’শ জনই এশিয়ান ! বাকি তিনশো জনের মধ্যে আছে শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, নেটিভ আমেরিকান, ল্যাটিন এবং অন্যান্য।
আমন্ত্রন পেয়ে দু’দিন আগে ছেলেকে নিয়ে স্কুলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম একজন অবিভাবক হিসেবে। সিনিয়র শিক্ষার্থীরা নতুনদের স্বাগত জানায়। এলিভেটরে সরাসরি নয়তলায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। অতঃপর সিঁড়ি দিয়ে প্রতিটি ফ্লোরে নেমে ঘুরিয়ে দেখানো হয়। স্কুলটির কোন ফ্লোরে কোন ডিপার্টমেন্ট, ল্যাব, সুইমিং পুলসহ সব।
শেষে ছাত্রছাত্রী, অবিভাবকে পরিপূর্ণ বিশাল থিয়েটার রুমে আরো প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া হয়। সেইসময়টাতে শতশত ছাত্রছাত্রীদের মাঝে এশিয়ানদের ব্যাপক উপস্থিতিতে অজান্তেই ভেতরটা গর্বে ভরে উঠে। নিঃসন্দেহে তাঁরা সকলেই মেধার, যোগ্যতার প্রমান দিয়েই স্কুলটিতে সুযোগ পেয়েছে। প্রবাসে ভালো থাকুক, সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাক আমাদের সন্তানরা।

 

রিমি রুম্মান নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
পছন্দের আরো পোস্ট