নিউইয়র্কের স্পেশালাইজড হাইস্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় মীমের সাফল্য

মিম, আমার একমাত্র মেয়ে। মিমের বয়স যখন ২১ মাস তখন আমার কোল জুড়ে আসে মিমের ছোট ভাই। সেই ২১ মাস বয়স থেকেই মিম তাঁর মায়ের দুঃখে দুখী, সুখে সুখী হতে শুরু করেছিল। ওই টুকুন বাচ্চা বয়স থেকেই মিম তাঁর মায়ের জীবনের সুখ-দুঃখের একমাত্র কান্ডারি, ভরসা হয়েছিল।

মিম তাঁর মায়ের সাথে রাত জাগতো ছোট ভাইয়ের দেখা শুনার জন্য। আমি অসুস্থ থাকলে ভাইয়ের দুদ গরম করে আনা, কখন কি লাগবে বলার সাথে সাথেই ছোট পায়ে দৌড়ে আমার হাতে এনে দিত। ছোট্ট মিম চেয়ারে দাঁড়িয়ে বেসিনে রাখা প্লেট,বাসন গুলো ধুয়ে ফেলতো। আমার জ্বর হলে বাথরুম থেকে গামছা ভিজিয়ে এনে আমার কপালে রাখতো, আর একটু পরপর জিজ্ঞেস করতো আমি একটু ভালো অনুভব করছি কিনা আগের থেকে। বাহিরে গ্রোসারি শপিং শেষে আমার হাতের বাজার গুলো সে নিজে বাসায় তুলতো। বিদেশ বিভুঁয়ে একা জীবনে মিম ছাড়া আসলে আমার অন্য কোন সাহায্যের হাত ছিল না। মনে পড়ে, একদিন দু’হাত ভর্তি বাজার নিয়ে মিম রাস্তার উপরে পড়ে গিয়ে ওর হাঁটুর চামড়া উঠে রক্তের ফোঁটা পুরো রাস্তায় পড়েছিল তবুও আমাকে কিছু বলেনি কারণ আমি তাঁর ভাইয়ের স্ট্রলার টানছিলাম তাই।

Post MIddle

একুশ মাস বয়স থেকেই মিম একা ঘুমানো, গোসল করা, দাঁত ব্রাশ করা এবং পরে ৪ বছর বয়স থেকে স্কুলে যাওয়া, বাসায় এসে হোমওয়ার্ক শেষ করা কোন কিছুতেই তাঁকে আমার বলতে হয়নি।

মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই অনেক চিন্তা আর শংকার মধ্যে আমার রাত-দিন, মুহূর্ত গুলো কাটছিল। নিউইয়র্কের ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন অনুমোদিত আটটি স্প্যাশালাইজড হাইস্কুলের জন্য আমার ছোট্ট মিম ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। পাঁচটি শহরের সমন্বয়ে নিউইয়র্ক স্টেটের এই আটটি স্প্যাশালাইজড হাইস্কুলের জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এই বছর ৩০, ০০০ হাজাড় শিক্ষার্থী এই আটটি স্কুলের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে যেখান থেকে মেধানুযায়ী মাত্র ৩০০০ শিক্ষার্থীকে নেবে স্কুলগুলো। মিম গত একবছর থেকে সপ্তাহে সাত দিন-ই কঠিন পরিশ্রম করেছে স্কুল গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য।

Bronx High School of Scienceরিজেন্ট টেস্টের জন্য আজ মিমের আফটার স্কুল ছিল। পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে শুনেই ভয়ে আমার হাত,পা গুলো শীতল হয়ে এসছিল। কাজে মন দিতে পারছিলাম না, কেমন যেন হাইপার হয়ে পড়েছিলাম। কাস্টমারদের সাথে অস্বাভাবিক আচরণ করছি দেখে পরিচিত একজন বলেই বসলো, “তোমার শরীর ঠিক আছে “? আজকের দুপুর বেলাটা যেন ছিল আমার জীবনের দীর্ঘতম দুপুর! কোনভাবেই ঘড়ির কাটা যেন সামনে এগুচ্ছিল না! মিমের সাথে ফোন নেই তাই ওর সাথে যোগাযোগ করাও সম্ভব নয়। আরো ৩ ঘন্টা আমার পক্ষে সুস্থভাবে অপেক্ষা করা সম্ভব নয় বলে মিমের বাবাকে স্কুলে পাঠিয়ে দিলাম মিমকে নিয়ে আসার জন্য।

আমার চোখে তখন ভাসছিল মিমের ২১ মাস বয়সের সেসব দিনগুলো। আমার ছোট বাচ্চাটা কত কস্টই না করেছিল আমার জন্য। আজ যদি মিম উত্তীর্ণ না হয় তাহলেতো আমার মেয়েটা কত কস্ট পাবে, কান্নাকাটি করবে। আমার এসব ভাবনার মধ্যেই মেয়েটা এসে যখন আমাকে পিছন দিকহতে জড়িয়ে ধরে বলল, সে তাঁর ফার্স্ট চয়েজ “ব্রক্সস সায়েন্সেই ” উত্তীর্ণ হয়েছে তখন কাজের যায়গাতেই সবার সামনে আনন্দ অশ্রুতে ভেসে গিয়েছিলাম…..!

সবাই দোয়া করবেন, আমার ছোট্ট মিম যেন তাঁর একাডেমীক সাফল্যের সাথে জীবনে একজন ভালো মানুষও হয়!

পলি শাহীনা । নিউইয়র্ক।

পছন্দের আরো পোস্ট