রাবিতে ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ নিয়ে বক্তৃতা

‘বাঙালি পরিচয় একই সাথে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। তাদের পরিচয়ের বিভিন্ন অনুষঙ্গ, যেমন ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিগত বৈশিষ্ট্য, ধর্ম ইত্যাদি সহজেই সহাবস্থান করে যতক্ষন না রাজনৈতিক অভিজাতেরা নিজেদের দৃষ্টিভংগীকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের আশায় সুকৌশলে পরিবর্তন ঘটায়। যখন প্রতিযোগীতায় থাকা অভিজাতেরা এইসব অনুষঙ্গকে একে অন্যের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেন তখন সংঘাতের উত্থান হয়। জাতীয়তাবাদীরা জাতি, রাষ্ট্র এবং পরিচয় এর ধারনাকে গঠন ও পূনর্গঠন করে রজনৈতিক শক্তি, বৈধতা এবং আর্থিক সুবিধা অর্জন করে।’ বেলজিয়ামের ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ কোঅপারেশন-এর অন্যতম পরিচালক ড. তাজিন ম্যাহনাজ মুরশিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ বক্তৃতায় এ কথাগুলো বলেন। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ‘বাঙালির আত্মপরিচয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্ভুক্তি : ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এই বক্তৃতা আজ ( ১৫ফেব্রুয়ারী ) বুধবার সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) আয়োজিত এই বক্তৃতায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মুহম্মদ মিজানউদ্দিন। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক প্রফেসর হাসান আজিজুল হক ও বিশিষ্ট চিন্তক-গবেষক-লেখক প্রফেসর সনৎকুমার সাহা। আইবিএস পরিচালক প্রফেসর স্বরোচিষ সরকার এতে সভাপতিত্ব করেন।

ড. তাজিন মুরশিদ তাঁর বক্তৃতায় আরো বলেন, ১৯৪০ এবং ৫০ এর দশকে, বিশেষত স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর, পূর্ব বাংলায় বাঙালির নিজস্ব পরিচয় গঠনের ইতিহাস খোঁজা হয়েছে। সামাজিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অথবা পরিচয়ক নির্মাণে বাংলাদেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নীতিগতভাবে সমজাতীয় ছিলেন না।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাঙালি মুসলমান ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় নিয়ে উভয় সংকটে পড়ে। যদি সে ধর্মকে গ্রহণ করে তবে সে ইসলাম কিরূপ সেটি নির্ধারনে মুসলিম লীগের অধিকার মেনে নিল; কিন্তু যদি সে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বেছে নেয় তবে সে বিদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই ধর্মীয় ধর্মনিরপেক্ষ উৎকণ্ঠা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অংগনকে উত্তপ্ত করে তোলে এবং বাঙালি মুসলমানের পরিচয়ের সংকটকে তীব্র করে তোলে।

Post MIddle

আমাদের ভাষা আন্দোলনের নানামুখী গুরুত্ব আছে। এটি বুদ্ধিজীবী সমাজের আত্মউপলব্ধির বৈপরিত্য নিয়ে তাদের অবস্থানকে চিহ্নিত করে। তাদের অবস্থান কখনো ছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। এগুলো প্রায়ই পরিচয়ের ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ মাত্রার প্রতিফলন ঘটাতো। এ উদ্বেগ কখনো কখনো বেদনাদায়ক বিরোধীতায় ঠেলে দিতো।

রাষ্ট্রভাষা নীতির বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া ছিল স্থানীয় সংস্কৃতি ও মূলের প্রতি এক ধরনের গর্বের বহিঃপ্রকাশ। প্রথম দিকে যদিও সাংস্কৃতিক এই আন্দোলন মধ্যবিত্তের একটা ছোট অংশে সীমিত ছিল, ভাষার প্রশ্নে এটি শ্রমিক শ্রেণিসহ বিশাল অংশের জনগণকে একত্রিত করে। এটি একটি অঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষমতার সংগ্রামের আত্মপ্রকাশকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু এটি ইসলামকে খারিজ করেনি।

জাতীয় রাজনীতিবিদরা একটি ‘নতুন ধারণা’ এর জন্ম দেন যা ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যবাদ এবং সমতার আলোকে নতুন ধরনের নীতির দাবি করে। বাংলার জাতীয় সম্মানে এর অর্জন সাংস্কৃতিক নয় বরং ছিলো রাজনৈতিক সাফল্য। এই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ১৯৭১ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিলো। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও এর শেষ হয়নি।

স্বাধীনতার পরের যুগে, এর গতিরেখা আবার পরিবর্তিত হয়। স্বাধীনতার প্রাক্কলে পরিচয়ের যে ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি গড়ে উঠেছিল তা সত্তর দশকের মাঝামাঝি প্রশ্নের সম্মুখিন হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ধারার মূল শক্তি ছিলেন, ১৯৭৫ সালে তার মৃত্যুতে নতুন শাসকদের সামনে নিয়ে আসে যারা নতুন ধরনের বিশ্বস্ততা ও পরিচয়ের আশায় নতুন নীতির চর্চা শুরু করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দেয়াটা ছিলো নতুন ‘শাসন নীতি’র অত্যাবশকীয় অংশ, যা আবারো ভাষা, পরিচয় ও সংস্কৃতির নাজুক কিন্তু বিতর্কিত বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা সুস্পষ্টভাবে সমর্থন করে যে পরিচয় কোন প্রদত্ত বা আদিম বিষয় নয়, বরং এটিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করা যায় ।

আইবিএস-এর পিএইচডি ফেলো মো. জাহিদুল ইসলাম ও এমফিল ফেলো নিবেদিতা রায় বক্তৃতা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

পছন্দের আরো পোস্ট