বিদেশীর চোখে বাংলাদেশ ও মিমের পরীক্ষা । পলি শাহীনা

আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজকের রবিবার এমন একজন মানুষের সাথে পুরোদিনটি কাটিয়েছি, যার সাথে কথা বলার সময় আমাকে ভেবে চিন্তে, দাঁড়ি, কমা দিয়ে কথা বলতে হয় না। যার সামনে মন,প্রাণ খুলে ইচ্ছেমত হাঁসতে পারি, মন চাইলেই কাঁদতে পারি। যে মানুষটি আমার অকারণ দোষ ধরে না। যে মানুষটি আমাকে মিথ্যে বলেনা, কথা বলার সময় মুখোশ পরে না , শতভাগ সততার সহিত আমাকে ভালোবাসে, সে আমার সুখ, দুঃখের সাথী, বন্ধু একমাত্র মেয়ে “মিম”!

Post MIddle

এলার্মের শব্দে ঘুম ভাংতেই ঘরের কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরেই তড়িঘড়ি করে মা, মেয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সিটে বসেই মিম বলল, সে তার বাবাকে সালাম করে দোয়া নিতে ভুলে গেছে আজ তার পরীক্ষার এই বিশেষ দিনে। মেয়ের কথা শুনেই, আমি নস্টালজিক হয়ে পড়েছি। হারিয়ে গেছি আমার ছোটবেলায়। বাবা-মা আমাকে শিখিয়েছেন কারো সাথে দেখা হলেই প্রথমে সালাম দিতে, প্রথমে যিনি সালাম দেন তিনি অহংকারমুক্ত থাকেন। বাবা-মার কথামত আমি সবাইকে দেখা হওয়া মাত্র সালাম দিলেও সম্ভবত এই দুনিয়াতে একমাত্র দু’জন মানুষ আমার বাবা,মা কে তেমন একটা সালাম দিয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। যখনি বাবা- মায়ের সাথে দেখা হতো বা উনাদের থেকে বিদায় নিতাম স্পষ্ট মনে আছে, আমি হা করে বেকুবের মত উনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তখন উনারা আমাকে উনাদের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতেন। চোখের পানিতে ভেসে যেতাম। ব্যাস এই পর্যন্তই।

আমার কাছে মনে হয় বাবা-মায়েদের সাথে সন্তানদের অদৃশ্য এক শক্তিশালী মাধ্যমে চোখে চোখে কথা হয়, ভাব বিনিময় হয়। দোয়া কি চেয়ে নেওয়ার জিনিষ? দোয়া, বদদোয়া এসব বলে কয়ে বাবা, মা থেকে নিতে হয় না! দোয়া, বদদোয়া স্বাভাবিক ভাবেই বাবা,মায়ের অন্তর থেকে সন্তানদের কৃতকর্মের উপর নির্ভর করে উৎসরিত হয়!

মা,মেয়ের গল্প শেষ না হতেই গন্তব্যে এসে পোঁছালাম। রিসিপশান ডেস্কে সাইন করেই সোজা পরীক্ষকের রুমে গেলাম। পরীক্ষক আমাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বললেন। মিমের ভাইভা শেষে বেরিয়ে আসলে জানতে চাইলাম, পরীক্ষক কি কি প্রশ্ন করেছেন? মিম আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করেছে? ঢাকা শহরে এত ট্রাফিক কেন? ঢাকা শহরে মানুষ কিভাবে বসবাস করে? সাইক্লোন কি? এত ছোট বাসায় সবাই কেন ঢাকায় থাকে? দেশের বিচার ব্যবস্থা কেমন? হাসিনা, খালেদার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা কেমন? বাংলাদেশে মশা নিধনের ব্যবস্থা আছে কিনা? মেয়ের প্রশ্ন শুনেতো আমার মাথা ঘুরতেছিল! ঝাঁঝালো কন্ঠে আবারো জানতে চাইলাম, উনি কি প্রশ্ন করেছেন? কি উত্তর দিয়েছো? পরীক্ষা কেমন হইছে? সেসব বলো। মেয়ে উত্তর দিল, আমি এশিয়ান, বাংলাদেশী শুনেই পরীক্ষক বললেন, বাংলাদেশের ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামের কথা, সাইক্লোনের কথা, মশার কথা, ছোট বাসায় ঘন জনবসতির কথা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা, নিরাপত্তাহীনতার কথা ইত্যাদি।

মেয়েটা ঠিক আমার মায়ের মত হয়েছে। আমার মুখ দেখেই বলে দিতে পারে আমার মনের অবস্থা। মিমের মুখে একজন বিদেশীর চোখে আমার বাংলাদেশের এমন চিত্র কল্পনা করে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে দেখে মেয়ে এবার বলল, আম্মু উনি আরো জানতে চেয়েছেন বড় হয়ে আমি কি হবো? উত্তরে বলেছি আইন বিষয় নিয়ে আমি পড়াশুনা করবো। পরীক্ষক বলেছেন, আইন বিষয় কেন আমার পছন্দ? উত্তরে মিম বলেছে, নির্যাতিত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চায় সে!

মিমের এই উত্তর শুনে আনন্দে আমার দু’চোখ ভিজে এসেছে অজান্তেই! ঝাপ্সা চোখে ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে মা,মেয়ে আবার ট্রেন ষ্টেশনের দিকে গল্প করতে করতে পা বাড়ালাম……….!

পছন্দের আরো পোস্ট