নেশা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গ্রন্থাগারের ভূমিকা

নেশা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষবাষ্পে আক্রান্ত বিশ্ব । এটি শুধু এদেশেই নয় সারা দুনিয়ারই আলোচিত সমস্যা । মাদকের থাবায় আক্রান্ত হতাশাগ্রস্ত তরুণ সমাজ ধীরে ধীরে পা বাড়ায় পকেটমার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, মানব পাচারসহ ভয়ংকার অপরাধে । খুন, টেন্ডারবাজি, রাজনৈতিক মাস্তানি, জমি দখল ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সন্ত্রাসীরা অনেকেই ভাড়ায় খাটে ।

ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে একটি গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক চক্র বিশ্বের ধর্মপ্রান মুসলমানদের মধ্য থেকে কিছু বিপদগামী তরুণদেরকে ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও পদ্ধতিকে ধ্বংস করার পায়তাড়া চালাচ্ছে । ধর্মীয় কুসংস্কার ও দারিদ্রতাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করছে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে । অতিমাত্রায় ফ্যান্টাসীতে ভোগা বিত্তবানদের তথাকথিত আধুনিক হাল-ফ্যাসনে গড়ে ওঠা ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরাও জড়িয়ে পড়ছে নেশা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে । ফলে এ সমাজেই সৃষ্টি হয় ঐশী, মুগ্ধ, সুমিত ও নিবরাসরা ।


তরুণদের নেশা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণ

ফুটবলের রাজা পেলের মতে, মানুষের পেটের খোরাকের সাথে সাথে মনের খোরাকও যোগাতে হয় । খাঁটি সোনা দিয়ে যেমন গহনা হয়না, প্রয়োজন হয় খাঁদের । তেমনি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধূলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি পাঠ্যক্রম বহির্ভুত কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকাও আবশ্যক। খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, গ্রন্থাগার ইত্যাদির রয়েছে যথেষ্ট অপর্যাপ্ততা। ফলে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না । তাদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে এক ধরনের হতাশা । আশা-নিরাশার দোলাচলে দিকভ্রান্ত তারা ।

বয়:সন্ধিক্ষণে তরুণরা একটু বেশি আবেগ প্রবন থাকে । একশ্রেণীর রাজনৈতিক, ধর্মব্যবসায়ী ও স্বার্থন্বেসী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এদের মগজধোলাই করে । ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে তারা বিপদগামী । সন্তানের প্রতি পিতা মাতার অযত্ন ও অবহেলা, পরিমিত শাসনের অভাব এবং অতিরিক্ত হাত খরচ দেয়ার কারণেও ছেলেমেয়েরা বকে যায় । অভিভাবকরা অনেক সময়ই খোঁজ খবর রাখেন না তাদের সন্তানেরা কোথায় যায়, কী করে, কোন পরিবেশে এবং কাদের সাথে সময় কাটায়। আবার অনেক সময় পারিবারিক কলহও ছেলেমেয়েদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত লেখাপড়া ও পরীক্ষার চাপ, পুরানো ধাচের শিক্ষা ব্যবস্থা ও মুখস্থ বিদ্যার প্রভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অল্প বয়সেই পড়াশোনার প্রতি একধরনের অনীহা সৃষ্টি হয় । আবার বাসা-বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মার্কেটে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে অনেকটা অনিরাপদ ও অনিয়ন্ত্রিত। নানা ধরনের লোকের সাথে ছেলেমেয়েদের গড়ে ওঠে সখ্যতা । এ সুযোগে বিপদগামী ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করছে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ সমাজকে । তাদের হাতে দিচ্ছে অর্থ, মাদক ও অস্ত্র । ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার, সমাজে অস্থিরতা, পারিবারিক বিরোধ, সন্দেহ-অবিশ্বাস, সমাজ বিচ্ছিন্নতা, বেকারত্ব, প্রযুক্তির প্রসার, আধুনিক ও মানবিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদির কারণেও আমাদের তরুণ সমাজ নেশা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদমূলক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।

এছাড়াও বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট, সমাজ ও রাজনীতিতে বিরাজমান অস্থিরতা, পরপস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শত্রুতা, সমাজে ঘটে যাওয়া অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে রাজনৈতিক রঙে আবিষ্ট করে ফায়দা তোলা, একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার মানসিকতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশের ঘাটতি, রাজিৈনতিক হাতিয়ার হিসেবে তরুণ প্রজন্মকে ব্যবহার করাও এ দেশের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রসারের কারণ।

Post MIddle

নেশা

, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রুখতে গ্রন্থাগারের ভ’মিকা ও আমাদের করণীয়
পড়িলে বই – আলোকিত হই, না পড়িলে বই অন্ধকারে রই ।  দেহ, মন ও আত্মার প্রশান্তি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশের নামই শিক্ষা । আর এই শিক্ষার প্রধান উপকরণ হচ্ছে বই । বই জ্ঞানের বাহক ও আনন্দের প্রতীক। ভাল বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে । বইয়ের আকর্ষণ আদিম আকর্ষণের মতোই দুর্বার। যার মাধ্যমেই মানুষের প্রতিভার স্পন্দন অনুভ’ত হয় । বই পবিত্র এক আলোক দীপ্তি ।

আলোকিত মানুষ ও সুশীল সমাজ গড়তে জ্ঞান চর্চা ও এর উপকরণ যেমন- বই, পত্রিকা, সাময়িকী ইত্যাদি সংরক্ষণের কেন্দ্র হচ্ছে পাঠাগার বা গ্রন্থাগার । এটি শক্তি, সৌষ্ঠব, বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানের ভান্ডার যা মানসিক শক্তির বিশাল সরোবর । যাকে আমরা জ্ঞানের মন্দির বলি । গ্রন্থাগার মানুষের জীবনে এক শ্বাসত আলোক উৎস । যা আলোকিত করে তোলে মানুষকে । আর তাঁদের আলোয় আলোকিত হয় সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব। গ্রন্থাগারের অবদানেই যুগে যুগে সৃষ্টি হয় আরজ আলী মাতুব্বরের মতো আলোকিত মানুষ, দার্শনিক, মানবতাবাদি, চিন্তাবিদ ও লেখকের ।

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মানসিক বিকাশে প্রতিটি স্কুল, কলেজ, ইউনিয়ন, গ্রাম, পাড়া মহল্লায় গ্রন্থাগার স্থাপন করা দরকার । সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠতে পারে পাঠাগার। এমনকি প্রতিটি ক্লাব ঘরে একটি কক্ষ পাঠাগার হিসেবে ব্যবহার হলে সেখানে সকল বয়সই মানুষ পত্রিকা, গল্প, উপন্যাস, ধর্মীয় বই পড়ে একটি পাঠোভ্যাস গড়ে তুলতে পারে । ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে সৃজনশীল ও চেতনার উম্মেষ । সুস্থ দেহ, প্রশান্ত মন মানুষকে সুখী করে। জীবনে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে করে সহায়তা । সুন্দর সমাজ গঠনে চাই সুস্থ দেহ ও সুন্দর মনের মানুষ । কথায় আছে সুস্থ দেহ, সুস্থ মন, সুস্থ চিন্তারই বাহন । সুস্থ দেহ ও সুন্দর মন গড়তে গ্রন্থাগারের পাশাপাশি ব্যায়ামাগারেরও রয়েছে ইতিবাচক ভ’মিকা।

অসুস্থ রোগী ও সর্বসাধারণের চিকিৎসার জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি করে সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে । শরীরচর্চা বা শারিরিক কসরৎ যেমন শরীরে রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে ঠিক তেমনি গ্রন্থাগার ব্যবহারে পাঠোভ্যাস গড়ে ওঠে । ফলে ঘটে মেধার বিকাশ এবং ধীরে ধীরে এর কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পায়। সমাজে নানা বিষয়ে সচেতনতা তৈরী হয়, নিজেদের মধ্যে একত্রিত হবার সুযোগ ঘটে, মত প্রকাশের পাওয়া যায় উপযুক্ত পরিবেশ। পাঠোভ্যাস খারাপ সঙ্গ, আড্ডা, নেশা, সন্ত্রাস ইত্যাদি ত্যাগ করতে এবং তা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে ।

গ্রন্থাগার প্রকৃত অর্থেই দেখাতে পারে আলোর ঠিকানা । নেশার কবল থেকে ফেরাতে পারে সুস্থ জীবনে, শেখাতে পারে বাস্তবতা এবং মুক্ত ও মানবিক চিন্তায় উদ্ভুদ্ধ করে নির্মূল করাতে পারে ধর্মীয় গোড়ামী, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের । জ্ঞান, আলো ও হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য বই হোক শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও বই হোক নিত্য দিনের সঙ্গী । ##

 

পছন্দের আরো পোস্ট