নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব

Bashirনবান্নের শাব্দিক অর্থ কিংবা উৎপত্তি দিকে আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তার পরও এক কথায় বলতে পারি, ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, একসময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এ মাস বাঙালির ঐতিহ্যবাহী, অসাম্প্রদায়িক ও মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কশাঘাতে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার আনন্দময় সরল জীবন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবল প্রভাব। তবে নাগরিক জীবনে নবান্নের শুভক্ষণের শুভ ছায়া ছড়িয়ে দিতে অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসব। সত্যিই কথা বলতে কী- শহুরে জীবনে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটা তো প্রতীকী।

Post MIddle

আজকের গ্রামবাংলার শিশুরা যেন স্বপ্নের মধ্যে নবান্নের উৎসবের ইতিকথা বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদীর মুখে মুখে শুনে। বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলার ঐতিহ্যগুলো ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। আসলেই, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। অগ্রহায়ণের শুরুতেই এপার বাংলা ও ওপার বাংলাতে চলে উৎসবের নানা আয়োজন। নতুন ধান কাটা আর সেই ধানের প্রথম অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার উৎসব। হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যায় সোনালি ধানের ক্ষেত। পাকা ধানের সোনালি রঙ দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভরে যায়। এই শোভা কারণ, কৃষকের ঘর ভরে উঠবে গোলা ভরা ধানে। বছর ঘুরে আবার এসেছে অগ্রহায়ণ। বাঙালির প্রধান কৃষিজ ফল কাটার ক্ষণ। স্মরণাতীত কাল থেকে বাঙালির জীবনে পয়লা অগ্রহায়ণকে বলা হয়ে থাকে বাৎসরিক সুদিন। এদিনকে বলা হয় নবান্ন। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকমের খাবার; বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে।

ছোটবেলায় দেখেছি- অগ্রহায়ণের নতুন ধান ঘরে আনার আগে মা লোক দিয়ে মাটি এবং গোবর গুলিয়ে বাড়ির আঙিনা ও ধানের গোলা লেপে পরিপাটি করতেন। লোকজন নতুন ধানের আঁটি মাথায় করে এনে ফেলা হতো লেপে রাখা ওই উঠোনে। এরপর মাড়াই করে ধান রোদে শুকিয়ে মচমচে করা হতো। মা সেই ধান ঢেঁকিতে পিষে চাল তৈরি করতেন। এরপর সন্ধ্যায় ওই চালগুড়ো করে তৈরি করা হতো পিঠা-পায়েস। কৃষকরা সারা দিন কায়িক পরিশ্রম করে উঠোনের পাশে বসে যেতেন খেতে। আর আমরা পিঠাপুলি নিয়ে আনন্দে ছোটাছুটি করতাম। বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। আর ঝি-জামাইদের সে পিঠায় আপ্যায়ন করা হত। এক সময় ঢেঁকির সুরেলা শব্দ ফুটিয়ে তুলত নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণের প্রথম শুক্রবার গ্রামবাসী মসজিদে সিন্নি দিতেন। জুমার নামাজ শেষে উপস্থিত মুসলিদের সিন্নি বিতরণ করতে করতে বিকাল হয়ে যেত।

আগে নবান্ন উৎসবে খাবার খাওয়ার প্রতিযোগিতা করা হতো। যে যত বেশি খেতে পারত তাকে উপহার দেয়া হতো। উপহার ছিল দুগ্ধবতী গাভী কিংবা ছাগল। বিভিন্ন স্থানে মেলা বসত। অবস্থা ভালো যেসব কৃষকের তারা নবান্ন উৎসবকে ঘিরে লাঠিখেলা, হা-ডু-ডু, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচসহ বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করত। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্নে বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইয়র’ আনা হয়। নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র ধ্বনিত হয়, ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন সবার ঘরে ঘরে।’ নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে মিলাদ পড়ানো হয়। মসজিদে সিন্নি দেওয়ার রেওয়াজও আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকের ঘরে পূজার আয়োজনও চলে।এখন এসব অতীত। আর বর্তমান ডিজিটাল যুগে খেলার জায়গা বলতে এক চিলতে বারান্দা। নগরীতে শিশুর খেলা মাঠ এখন ট্যাব,মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের ছোট্ট মনিটর। পাড়া-মহাল্লায় না স্কুলে কোথাও আমাদের সন্তানদের জন্য খেলার মাঠ নেই। দূরন্ত শৈশবটাই যেনো হারিয়ে যাচ্ছে তাদের। নগরায়ন আর আধুনিকতার অজুহাতে বিলীন হয়েছে খেলার মাঠ। তেমনি গ্রামীণ জনপদে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ আছে; কিন্তু কৃষকের ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী আগেও নবান্নের ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। গ্রামীণ জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন শুধুই স্মৃতি।

আগে কৃষকের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল আমন ধান। বর্তমানে আমনের জায়গা দখল করেছে আউশ-আমন-বোরো ধান। বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান বাজারে আসায় নতুন ধানের গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে এবং স্বল্প সময়ে ওইসব ধান উৎপন্ন হওয়ায় গ্রামবাংলার ঐত্যিবাহী নবান্ন উৎসব হারিয়ে যেতে বসেছে। ধানের বীজ থেকে চাল উৎপাদন হওয়া পর্যন্ত সব কাজই এখন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হচ্ছে। এখন ধান উৎপাদনে আগের সেই পরিশ্রমও যেমন নেই, তেমনি চালের মজাও নেই। যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের বাপ-চাচার গরু-নাঙ্গল দিয়ে চাষ করে আবার গরু দিয়ে ধান মাড়াই করে অনেক কষ্টে নতুন ধান উৎপন্ন করতেন, তখন তারা এই আনন্দে পিঠাপুলির আয়োজন করত। এখন সেই কষ্টও নেই, সেই আনন্দও নেই।

বাংলার কৃষকের ঘরে ঘরে আগের মতো নবান্ন উৎসবের আমেজ কিংবা জৌলুস না থাকলেও ইংরেজী মাসের ১৫ নভেম্বর বাংলা মাসের ১ অগ্রহায়ন নবান্ন উৎসবের দিন ছিল। এক সময় অগ্রহায়ণ জুড়ে কৃষক এবং তাদের পরিবারের সবাই নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে মুগ্ধ থাকত। উৎসব আর আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত কৃষকের ঘরে ঘরে।

আজ বর্তমান যুগে রাইচ মিলে চাল ভানার কাজ চলছে। কোনো কোনো স্থানে ডিজেলের মেশিন ছাড়াও ভ্যান গাড়িতে ইঞ্জিন নিয়ে বাড়ী বাড়ী যেয়ে ধান ভানা ও মাড়াই করছে। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে লাঠিখেলা, হা-ডু-ডু, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচসহ বিভিন্ন খেলাধুলার কথা ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম। কারণ বর্তমানে ভিনদেশী চাকচিক্য সংস্কৃতি সমাজে প্রবেশ করে আমাদের পুরোনো নিজস্ব ঐতিহ্যকে পশ্চাতে ফেলে যেন জ্যামিতিক হারে এগিয়ে চলছে। ঠিক আমাদের পুরোনো সংস্কৃতি গাণিতিক হারের মত দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই এই দুর্বলতাকে পাশকাটিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে আমরাই লালন করতে হবে। তখন ইতিহাসের পাতায় পড়া ছাড়া বাস্তবে খুঁজে পাওয়া দুঃপ্রাপ্য হবে।

নবান্ন এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নবান্ন উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। তাই সরকারে কাছে আমার আকুল আবেদন পহেলা বৈশাখে মত নবান্ন উৎসব সারাদেশে পালন করা হোক। নবান্ন উৎসব বাঙালির জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক- এ প্রত্যাশা রইল।

মো. বশিরুল ইসলাম, জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত), শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

পছন্দের আরো পোস্ট