নিউইয়র্কে নারী ম্যাগাজিনের বর্ষপূর্তি ও আমরা নারীরা

14937115_1241261465941913_2303299_n“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে, বসি কবিগণ
সোনার উপমাসুত্রে বুনিছে বসন ।
সঁপিয়া তোমার পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা ।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন ।
পড়েছে তোমার পরে প্রদীপ্ত বাসনা
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা ।”
 
— এগুলো রবি ঠাকুরের কথা । নারীর সৌন্দর্য কত যে শক্ত একটি ভীত , তা আমরা টের পাই । জগতের মননে আটকে আছে নারীর নির্ভরশীলতা, সহনশীলতা, ও আনুগত্যের প্রতিমূর্তি হিসেবে । নারীর অবয়ব নির্মিত হয় পুরুষালি অবয়বের বিপরীতে । পৃথিবীর জীবদ্দশায় পুরুষের মনে ঢেউ তুলবে নারীর ললিত লোভন লীলা । তবে নারী শব্দটিকে বিভাজনের ক্ষেত্রে আমি রাজী নই । পৃথিবীতে নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা না থাকলে দেশ সমাজ গড়া সম্ভব হত না । তবে নারী যেহেতু কন্যা জায়া জননী , সেহেতু নারীর অবস্থান সম্মান একটু উঁচুতে । আমাদের বাবা ভাই স্বামী ছেলেরা পুরুষ । তাঁদের প্রতিও আমরা যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি । পৃথিবীকে অলংকৃত করেছে নারী এটা অস্বীকার্য ।
নারীর ছন্দে রুপ বাহারে সাবলীল আর গতিশীল এই পৃথিবী । নারী কিশোরী থেকে তারুণ্যে এসেছে । তারুণ্য থেকে পূর্ণ যৌবনা হয়েছে । হয়েছে কারও প্রেয়সী কারো স্ত্রী তারপর একদিন মা হয়েছে । তারুণ্যে এসে যখন সে ফুটে কারো চোখে পৃথিবীর বিশুদ্ধতম ফুল হিসেবে । চারদিকে স্বপ্নময় স্বাধীন জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে , তখনই তাকে লড়তে হয় জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা-বিপত্তিগুলোর সাথে । চারদেয়াল এমনকি বাইরের জগতের সাথে তাকে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয় । অনেক সময় সে উতরে উঠে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে । আজো বিভিন্ন পর্যায়ে নারী অবহেলিত হচ্ছে । তাঁদের যথার্থ মূল্যায়ন হয়না । এত বৈপরীত্যের মধ্যেও বহু সচেতন ব্যক্তি নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার । অনেক পরিশ্রম করছেন তাঁরা , এবং এটি জ্বলন্ত সত্য যে নারীর অধিকার তাঁদের মর্যাদা নিয়ে কাজ করার মধ্যে পুরুষও আছেন । হৃদয়ের গহীন থেকে সেইসব শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের লাল সালাম জানাই ।
 
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘নারী’ ম্যাগাজিন । ২৮ অক্টোবর শুক্রবার শীতের সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল নারীর বর্ষপূর্তি । পপি চৌধুরী একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি । সৃষ্টিশীল কাজে ব্যতিব্যস্ত এই মানুষটি আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন । বর্ষপূর্তির প্রোগ্রামে যাবার আমন্ত্রণ পপি আপা আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। যদিও শীত সবে উঁকিঝুঁকি মারছে। কিন্তু শীতের প্রকোপ সেদিন একটু বাড়ন্ত ছিল। আগের দিন দুপুরে নাসরিন আহমেদ আপার সাথে ফোনে কথা হল। আপার কাছ থেকে যেন রিচার্জ হয়ে নিলাম। পায়ের পেশীতে টান লেগেছিল বলে হাঁটতে ভয় পাচ্ছিলাম। যেহেতু বাস ট্রেনের পথ। কিন্তু নাসরিন আপার তেজোময় উক্তিতে মনের অজান্তে যেন পেশীর টান সেরে গেল। অনেক উদ্দীপনা অনুভব করলাম।
14600910_1238184859582907_7553942100334669696_nবন্ধু রিমি রুম্মান ছোটবোন পলি শাহীনাকে কনফার্ম করলাম নারী’র প্রোগ্রামে যাচ্ছি। ওরা অনেক খুশি হল। প্রবাসের  বোরিং লাইফের ফাঁকে কিছুটা সময় গেট টুগেদার হতে খুব ভাল লাগে। বন্ধু রিমি রুম্মান খুব মেধাবী লেখিকা। তার লেখার হাত সাবলীল। ছোটবোন পলি শাহীনাও ভাল লেখে। আমি মুগ্ধ হই যখন ওদের লেখা পড়ি । গর্বও করি ওদের নিয়ে।
পপি আপা তাঁর অমায়িক ব্যবহার আন্তরিকতা দিয়ে অতিথিদের সম্ভাষণ জানালেন। যখন জুইশ সেন্টারে পৌঁছলাম শুরুতে ফরিদা আপার সামনে পড়লাম। ফরিদা আপা সম্পর্কে দু’একটি কথা না বললেই নয়। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। যাদুময়ী রমণী ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি ব্রংকস্ বাংলাদেশ উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। একজন সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষক। কম্যুনিটিতে নারীদের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলেছেন।
14522898_1238187219582671_4028732983969468195_n
ফরিদা আপা পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি ফারজানা ইয়াসমিনের সাথে। তোতা সবুজ গোলাপি সোনালী কম্বিনেশনের একটি অপূর্ব শাড়ি পরেছিলেন ফারজানা আপা। প্রথম সাক্ষাতেই মিলেমিশে একাকার। ফরিদা আপার পরনে ছিল অফ হোয়াইট কালার সিল্ক শাড়ি। মাল্টিকালারের বুনন শাড়ির জমিনে আঁচলে। আমাদের দেশের সিল্ক শাড়ি। আমাদের ঐতিহ্য বহন করে যেসব কারুকাজ। আমার শ্রদ্ধেয়া মুনিয়া মাহমুদ আপার সাথেও সেদিন প্রথম মোলাকাত হয়। যদিও মুনিয়া আপার সাথে ফোনে যোগাযোগ ছিল আগে থেকে। মুনিয়া আপাও একজন প্রতিভাবান লেখিকা। ফরিদা আপা রিমি পলি মুনিয়া আপা নাসরিন আপার মধুময় সান্নিধ্য পেয়ে মনপ্রাণ ভরে উঠছিল। নাসরিন আপা আমাকে দেখিয়ে পলিকে বললেন,  “ওকে দেখে  কি অসুস্থ মনে হয়,  বলো তো ?” আসলে কিছু উক্তি নিজেকে বেশ মজবুত করে। নাসরিন আপার উক্তিগুলো তেমন । 
14600881_1238185439582849_3683279439962218849_n
অনুষ্ঠানে পাঁচজন মহীয়সী নারীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান জন্য বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়। তাঁরা হলেন ভয়েস অব আমেরিকার সাবেক সংবাদ পাঠিকা সুসাহিত্যিক  দিলারা হাশেম, নাট্যাভিনেত্রী রেখা আহমেদ, নারী নেত্রী ও লেখিকা নূরজাহান কাদের, লেখিকা তাহমিনা জামান, নুরজাহান বোস। পীচ কালার শাড়ি পরনে সামনের সারিতে নিষ্প্রভ হয়ে বসা ছিলেন দিলারা হাশেম। কষ্টে তাঁর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ২০১০ সালে মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলায় কি অসম্ভব প্রাণবন্ত ছিলেন এই মানুষটি। কোন অসুস্থতা ছিলনা তাঁর  সেদিন। নীল সিল্কের শাড়ি ছিল তাঁর পরনে ।
Post MIddle
সেদিন আমি দিলারা হাশেমের সাথে অনেক ছবি তুলেছিলাম। তাঁর গায়ের সুগন্ধ নিয়েছিলাম। আজ অনেকটা স্থবির এই মানুষটি। ঠিক মত কথা বলতে পারছিলেন না। চেহারায় অসুস্থতার ছাপ অনায়াসে বোঝা যাচ্ছিল । চেহারা কুঁচকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন বার বার । কখনো তাঁকে অস্থির শিশুর মত দেখাচ্ছিল। আমি ইচ্ছা করে তাঁর সামনে যাইনি । কেউ কেউ গিয়ে দিলারা হাশেমের চেয়ারের পাশে পা মুড়ে বসে টুকটাক কথা বলেছে । ছবি তুলেছে । কিছুক্ষণের বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
এই কি সেই দিলারা হাশেম যিনি ২০১০ সালে কথা ও ব্যক্তিত্বের  মিষ্টতা দিয়ে আমাদেরকে মাতিয়ে রেখেছিলেন !! আমি সেদিন বাসায় ফিরে এফবিতে পুরনো এলবাম খুঁজতে বসে গেলাম । দিলারা হাশেমের পুরনো ছবি জুম করে তাঁর অভিব্যক্তি দেখলাম । আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল গরম অশ্রু । আমার কন্যা তার মাকে কাঁদতে দেখে প্রশ্ন করল । ওকে বললাম,  আমার খুব শ্রদ্ধেয়া একজন মানুষের অসুস্থ চেহারা আমার বুকে কান্না জমিয়েছে।  
14632974_10207612047006231_846687657799121890_n
প্রখ্যাত লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তকে আদাব জানাতেই মুচকি হেসে কুশল বিনিময় করলেন । এই বরেণ্য ব্যক্তির সাথে কথা বলে ধন্য হয়ে গেলাম। তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী পূরবী বসু অনুষ্ঠান তদারকি করছিলেন। তিনি নারী ম্যাগাজিনের উপদেষ্টা। রোকেয়া হায়দারকে দেখা গেল অনুষ্ঠান আলোকিত করতে। মনে পড়ে ছোটবেলায় রেডিওতে আব্বাকে ভয়েস অব আমেরিকা এবং বিবিসির খবর শুনতে দেখতাম। খবর পাঠক পাঠিকা রোকেয়া হায়দার তাঁর ভাই সরকার কবীর উদ্দিনের নাম কত শতবার শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। বিবিসির গোলাম ফারুক মাসুদা ভাট্টি আমার ছেলেবেলার খুব পরিচিত নাম ।  
সমাজে নানা ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অবদান রাখার জন্য পাঁচজন নারীকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়েছে । এই পাঁচ নারী হলেন ভয়েস অব আমেরিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক দিলারা হাশেম, নাট্যাভিনেত্রী রেখা আহমেদ, লেখিকা তাহমিনা জামান, লেখিকা নুরজাহান বোস, নারী নেত্রী ও লেখিকা নুরজাহান কাদের । জুইশ সেন্টারের হলরুমটি আলোকিত মুখরিত হয়ে উঠেছিল সাহিত্যপ্রেমী সামাজিক রাজনৈতিক সুশীল সমাজের নেত্রীবৃন্দের প্রাঞ্জল অংশগ্রহণে । দিঠি হাসনাতের উদ্বোধনী সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হয় ‘নারী’র বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান । নাট্যাভিনেত্রী লুতফুন নাহার লতার আবৃত্তি হৃদয় ছুঁয়ে যায় । লতার কণ্ঠের আবেগে মোহিত হয়ে পড়েন হলভর্তি দর্শক।
14731322_1238187409582652_3913209285957100923_n
পপি চৌধুরী স্বাগত বক্তব্যে তাঁর কঠিন যাত্রার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন । কঠিন পথ কিভাবে পাড়ি দিয়ে চলেছেন সেই সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেন । আরও বক্তব্য রাখেন ‘নারী’র প্রকাশক তপন চৌধুরী । তাঁরা ম্যাগাজিনটির প্রকাশে যারা সহযোগিতা পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন লুবনা কাইজার । সদ্য প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, কবি শহীদ কাদরী, কবি রফিক আজাদ, বেগম পত্রিকার সম্পাদক নুরজাহান বেগম, ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবী, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ তাঁদের লেখার অংশবিশেষ পাঠ করা হয় ।
বিশেষ সম্মাননা পাওয়া পাঁচ নারীর জীবন বৃত্তান্ত পড়ে শোনান ‘নারী’র উপদেষ্টা এবং খ্যাতিমান লেখিকা পুরবী বসু , নারী’র উপদেষ্টা ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান প্রাক্তন সংবাদ পাঠিকা রোকেয়া হায়দার, বিশিষ্ট আইনজীবী ও কলামিস্ট নাসরিন আহমেদ । নাসরিন আহমেদ তাঁর মনকাড়া স্বাগত বক্তব্যে নারী ম্যাগাজিনের ভূয়সী প্রশংসা করেন ।
সম্পাদক পপি চৌধুরী এবং পত্রিকায় যারা লিখে আসছেন তাঁদেরকে তিনি অভিনন্দিত করেন । গুণী পাঁচ নারীর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন যুক্তরাষ্ট্র সফররত উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাংবাদিক কামাল লোহানী, একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক ডঃ জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ।
14915369_1238185012916225_9093527170580743291_n
অনুষ্ঠানে বহু গুণী ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন । তাঁরা হলেন, সাপ্তাহিক ঠিকানার অন্যতম  কর্ণধার সাঈদ- উর- রব, প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, সাপ্তাহিক আজকাল সম্পাদক মনজুর আহমেদ, বিপণন প্রধান আনিসুর রহমান, সাপ্তাহিক বর্ণমালার প্রধান সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, সাপ্তাহিক বাংলা টাইমস সম্পাদক সঞ্জীবন কুমার সরকার, এটিএন বাংলা ইউএসএ’র বার্তা প্রযোজক সাংবাদিক কানু দত্ত, সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম, সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, আকবর হায়দার কিরণ, নারী  নেত্রী অধ্যাপিকা হুসনে আরা বেগম, অধ্যাপিকা নাঈমা খান, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সভাপতি নার্গিস আহমেদ, কবি শামস আল মমিন, লেখক গীতিকার আবু রায়হান, কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবিএম  সালেহ উদ্দিন, কবি রওশন হাসান, সাংবাদিক লেখক মনিজা রহমান, লেখক বেলাল বেগ, রাজনীতিবিদ ও কবি লিয়াকত আলী এবং তাঁর সহধর্মিণী মমতাময়ী সানোয়ারা ভাবী,  শামসুদ্দিন আজাদ, আব্দুস শহীদ, ফটো সাংবাদিক নিহার সিদ্দিকী, কম্যুনিটির পরিচিত মুখ ও  সমাজসেবক ক্যান কাদের প্রমুখ।
পছন্দের আরো পোস্ট