পবিত্র রমজান মাসের জনদূর্ভোগ লাঘব চাই

Captureআমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের বলতে শুনে, রমজানে একমাস ব্যবসা করবো-সারা বছর আরামে কাটাবো। এ আরামে জন্য, রমজান মাসে নিত্যপ্রযোজনীয় সব কিছুর দাম ন্যায্য মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে রজমানের পণ্যসামগ্রহীর, পবিত্র বড় দিন উপলক্ষে ইউরোপে ও আমেরিকার দেশগুলিতে পণ্যসামগ্রহীর বাজারে মূল্যহ্রাস প্রথা চালু আছে। কিন্তু তার বিপরীতে আমাদের দেশে পরিস্থিতি উল্টো। রমজান, ঈদ বা পুজো আসলেই খুচরো থেকে মাজারী ও বড় ব্যবসায়ীরা সাধারন ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মাতোয়ারা হন। ফলে জনগনের জনজীবন হয়ে উঠে নাভিশ্বাস।

 

রমজান মাসে ধনী-গরীব সকলেই একটু ভাল খেতে চায়। ঈদে ছেলে-মেয়েকে নতুন কাপড় পরাতে চায় । সেজন্য সারা বছর ধরে প্রস্তুতি নেয়। ঈদ উপলক্ষে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বোনাস হিসাবে বিশেষ সম্মানী দিয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবে পণ্যের চাহিদা বাড়ে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে, একশ্রেণির কালোবাজারি অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়া। এমন পরিস্থিতি দেশের সীমিত আয়ের মানুষের জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ব্যবসায়ীদের এমন বিবেকহীন কর্মকাণ্ডের কারণে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ে। রমজান মাসে আবার অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ীরও আর্বিভাব ঘটে, এ সমস্ত ব্যবসায়ীরা রমজান উপলক্ষে চিনি, ছোলা, ডাল, চাল, সয়াবিন, খেজুর, পাঞ্জাবী, শাড়ী ইত্যাদি পণ্যের পসরা সাজিয়ে থাকে। পবিত্র রমজান মাস মুসলিম বিশ্বের জন্য আল্লাহ দান এবং এটি সংযম নাজাতের মাস যা পাপ মুক্তির মাস হলেও এ সমস্ত মৌসুমি ব্যবসায়ী নামধারী মূল্য সন্ত্রাসীদের কারনে জনজীবন হয়ে উঠে অসহনীয় ও যন্ত্রনাদায়ক।

 

মোবাইল কোর্টের তৎপরতা সত্তে¡ও ভেজালকারীদের কবল থেকে ইফতারিও রক্ষা পাচ্ছে না। ইফতারির অপরিহার্য উপকরণ ছোলা, পিয়াজু, বেগুনি, মুড়ি ও জিলাপি। এ উপকরণগুলোর প্রতিটিই ভেজালের শিকার। মুড়ি ছাড়া ইফতার একটি অকল্পনীয় বিষয়। সেই মুড়ি আকারে বড় ও সাদা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড়্রাে সালফাইড। বাজারে বিষমুক্ত মুড়ি পাওয়া এখন সত্যিকার অর্থেই দায়। ইফতারি সামগ্রীতে আম, আপেল, কলা ইত্যাদি ফল ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক দিয়ে এসব ফল সংরক্ষণ ও পাকানোর বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। প্রশাসনের কড়া নজরদারিতে রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবস্থা খুবই নাজুক। রোজায় মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের কদর বাড়ে। মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে সোডিয়াম সাইফ্লাসেট নামের ভেজাল চিনি। মিষ্টি ও ইফতারি পণ্য রঙিন করতে ঢালাওভাবে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের রং। জিলাপি মচমচে রাখার জন্য তেলের সঙ্গে মেশানো হয় মবিল। ইফতারি তৈরিতে যে তেল ব্যবহার করা হয় সেখানেও রয়েছে ভেজালের রাজত্ব।

 

ফরমালিনের বিরুদ্ধে সরকার রীতিমতো যুদ্ধও ঘোষণা করেছে। কিন্তু খাদ্যদ্র্রব্যে অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেই। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি আমাদের অধিকার ও দায়িত্বগুলি সম্পর্কে সচেতন ও জ্ঞাত? যদি তাই হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরী করে পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে থাকে। তাহলে ভোক্তা হিসাবে আমরা কেন, তাদের সেই পাল্লায় পা দিব? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তারাই পণ্যের নিয়ামক। কারণ ভোক্তারা পণ্যটি ব্যবহার করলেই উৎপাদক লাভবান হবে। সেকারনে উন্নত দেশগুলিতে ভোক্তাদেরকে রাজা উপাধি প্রদান করা হয়।

 

বিপণী বিতানগুলোতে এমন অবস্থা যে,ক্রেতা বেধে পোশাকের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে একজন বিক্রেতা বা দোকানী যখন দেখে যে,একজন ক্রেতা চলনে বলনে কথাবার্তায় স্মার্ট ও পয়সাওয়ালা তাদের কাছে বিক্রেতা সুযোগে বেশ চড়া মূল্যে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করেন । তাছাড়া যদি কোনো কাস্টমারের কোনো একটি বিশেষ ফ্যাশনের পোশাক পছন্দ হয়ে যায়,তাহলে বিক্রেতা কখনোই ঐ পোশাকের দাম কমাতে চায় না তখন বাধ্য হয়েই ক্রেতাকে চড়া দামে পোশাক সামগ্রী কিনে নিতে হয়। ঈদের আগের দিন সব কিছুর দাম থাকে অন্য দিনগুলোর চেয়ে আরো বেশী মূল্য । বাসে ট্রেনে গাড়ীতে ও অন্যন্যা যানবাহনেও এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে সব কিছুর দাম হুহু করে বেড়ে যায়।

 

Post MIddle

রমজান মাস এলেই দেখতাম, বিদ্যুৎ সঙ্কট, মিনিটে মিনিটে শহরাঞ্চলে লোড শেডিংয়ের ধাক্কা, এটা আর তেমন দেখা না গেলেও ঢাকা শহরে যানজট নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সরকার বড় বড় ফ্লাইওভার নির্মাণ করে ঢাকা শহরকে ঢেকে দিতে পেরেছে। কিন্তু শহরের ভয়াবহ যানজট হ্রাস করতে পারেনি। সাধারনত, দুপুরের পর গোটা রাজধানীজুড়ে যে যানজটের সৃষ্টি হয় তা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বড়কর্তা থেকে শুরু করে ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল পর্যন্ত জানে। রমজান মাসে এই যানজট চরম পর্যায়ে চলে গেছে। অথচ যানজট নিরসনের কার্যকর কেনো পদক্ষেপ নেই। বরং ভুক্তভোগীদের অভিযোগ চাঁদা আদায় এবং তল্লাশির নামে মানুষকে হয়রানী করার কারণে যানজট বেড়ে যায়।

 

শুধু কি তাই, দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোনো সংস্কার না করা এবং কোনো কোনো এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই পানিতে ডুবে যায়। বৃষ্টি আর পানিবদ্ধতার কারণে রাজধানীজুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। রমজান মাসে ইফতারের আগে ব্যক্তিগত কাজে বের হয়ে এ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। জমে থাকা পানির কারণে সিএনজিচালিত অটোরিকশা রাস্তায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এছাড়া পানিবদ্ধতার কারণে জুতা খুলে অফিস, স্কুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতে হয়েছে অনেককে। কোথাও কোথাও রাস্তায় পানি জমে তা বাসের পাদানি পর্যন্ত উঠে গেছে। এতে বাসে উঠা-নামা করার সময় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্যও খানাখন্দকের সৃষ্টি হয়ে পানি জমে। রাস্তার এসব গর্তে যানবাহন পড়ে অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে।

 

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে বর্তমান পরিস্থিতিতে যা করা দরকার তা হলো- বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোকে কার্যকর করতে হবে। মধ্যস্থানীয় শ্রেণির কারসাজি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে ব্যবসায়ীদের ওপর বাজার নিয়ন্ত্রণের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সামঞ্জস্য আছে কিনা নিয়মিত তা তদারকি করাও জরুরি। এছাড়া, যানজট নিরসনে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।

 

রমজানের তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। সিয়াম সাধনার শিক্ষা ও এর মাধ্যমে অর্জিত জীবনবোধ যদি জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয়, তাহলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। এক মাসের সংযম সাধনার ভেতর দিয়ে আমাদের সবার জীবন পবিত্র ও পুণ্যস্নাত হোক। পরিশুদ্ধ জীবানাচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠি আমরা- রমজানে এই হোক আমাদের প্রার্থনা।

 

লেখকঃ 
জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত),শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 

লেখাপড়া/এমটি/১১৩

পছন্দের আরো পোস্ট