তরুণ প্রজন্মের ভাবনায় একুশ

IMG_1197ফেব্রুয়ারির সাথে আমাদের সকলের পরিচয় আছে। এই মাস যেমন বসন্তের, ঠিক তেমনি এই মাস ভালোবাসার। এই মাস ত্যাগের, এই মাস মহিমার, এই মাস একুশের। ১৯৫২ সালের এই মাসেই মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে জীবন দিয়েছিলো সালাম, রফিক, জব্বার, আরো আনেকে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালি মানবজাতির এই সর্বোচ্চ ত্যাগ ইতিহাসে সৃষ্টি করেছে মাইল ফলক। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়েই আমরা ছিনিয়ে আনতে শিখেছি আমাদের ন্যায্য অধিকার, দেখেছি দাবি আদায়ের পথ, পেয়েছি মুক্তি, পৃথিবীর বুকে আঁকতে পেরেছি লাল সবুজের এক নতুন মানচিত্র। ২১ আমাদের বাঙ্গালী চেতনাকে করেছে উদ্দীপ্ত।

 
১৯৯৯ এর ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) এর সাধারণ অধিবেশনে ইউনেস্কো সাধারণ পরিষদের ২১ ফেব্রুয়ারি কে প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইউনেস্কো আয়োজিত এক সম্মেলনে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশ বাংলাদেশের এই প্রস্তাবকে সর্মথন করে। অতঃপর সর্ব সম্মতিক্রমে তা অনুমোদিত হয়।

 

একুশ নিয়ে এই প্রজন্মের তরুণদের ভাবনা জানতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত জানতে চাইলে উঠে আসে বর্তমান একুশের চেতনা।

 

২১শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোনমী এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া বলেন, “পৃথিবীর মাতৃভাষা গুলোর মধ্যে বাংলা ভাষাই সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম যে, এই ভাষাটিতে তাঁর প্রাচীন রূপ থেকেই মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে লড়াই করে আসতে হয়েছে। বাংলার আদিকালে ‘সেন’ শাসন আমলে বাংলা ভাষার চর্চার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলা হয়েছিলো বাংলা ভাষা চর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যেতে হবে। মধ্যযুগে এসেও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অবহেলা থেমে থাকেনি। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ছিলো নানাবিধ ষড়যন্ত্র। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষাকে দাঁড় করানো হয়েছিলো প্রতিপক্ষ হিসেবে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয় মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বাঙ্গালী জাতির প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। ”

 

পাকিস্তান সরকারের নানা রকম চক্রান্ত, আঘাত ও অশুভ পদক্ষেপের কারণে আন্দোলন ক্রমান্বয়ে আরো বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত সহ আরো অনেকের রক্তে সৃষ্টি হয় মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহান ও অভূতপূর্ব ইতিহাস। বাংলাদেশ ও সমগ্র বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’’ শব্দ দু’টি একত্রে উচ্চারিত হলেই প্রতিটি বাঙ্গালীর স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে এক চিরন্তন চিত্রকল্প। হৃদয়ে বেজে ওঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কি ভুলিতে পারি…?

 
একুশ নিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম বলেন তার মত করে বলেন, “একটি জাতিসত্তার মূল বিষয় হচ্ছে ‘ভাষা’। আর আমাদের এই মূলসত্তাকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে। এককথায় পৃথিবীর ইতিহাসে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। ২১ ফেব্রুয়ারি আসার আগে শহীদ মিনারকে ধুয়ে-মুছে, চকচকে-ঝকঝকে করে তোলা হয়। সারা বছর যেখানের পবিত্রতা নষ্ট হয় সেখানে চাকচিক্য ফিরিয়ে আনার জন্য মাত্র কয়েক দিনে শ্রমিক দিয়ে শহীদ মিনার পরিষ্কার ও রং করা হয়। যে ভাষার জন্য জীবন দিলো ছাত্র জনতা আর তাদের স্মৃতিস্তম্ভের এই হাল আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে কোটি টাকার ফুল দেওয়া হয় শহীদ মিনারে তার কিছু অংশ যদি শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যয় করা হতো তা হলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো বলে আমি মনে করি।

 

Post MIddle

একুশ মানে শুধু একটি দিন নয়। মায়ের ভাষায় কথা বলার প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে একুশ। তাই একুশ বেচে থাকবে তার কৃতিতে, একুশ বেচে থাকবে আমর হয়ে। ”

 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “একটি জাতিসত্তার মূল বিষয় হচ্ছে ‘ভাষা’। আর আমাদের এই মূলসত্তাকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে। এককথায় পৃথিবীর ইতিহাসে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। ভাষার জন্য জীবন দেয়া প্রত্যেক শহীদের প্রতি এই মাসে আমি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি। ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের ঋণ কোনো দিন শোধ হওয়ার নয়। তাদের কারণেই বাঙালি হিসেবে বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উঁচু করে আছি। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাঙালি হিসেবে এটিও আমাদের বড় পাওয়া। একুশে ফেব্রুয়ারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। বুঝতে শেখার পর থেকেই আমি ভাষা শহীদদের স্মরণে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছেন। বাঙালির ইতিহাসে বায়ান্ন এসেছিল বলে একাত্তর এসেছে; পরে আমরা স্বাধীন জাতির স্বীকৃতি পেয়েছি। যে চারটি বড় স্তম্ভের ওপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অন্যতম প্রধান স্তম্ভটি হলো জাতীয়তাবাদ। আবার এই জাতীয়তাবাদের চেতনাবাহী প্রধানতম স্তম্ভ হলো ‘ভাষা’। আমরা আমাদের বাংলা ভাষা নিয়ে গর্বিত”।

 
স্টামফোর্ড ইউনির্ভাসিটির শিক্ষার্থী জেরিন তাসনিম অর্চি বলে, “২১ শে ফেব্রুয়ারি মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতি হিসাবে এই দিনটি একদিকে যেমন আমাদের শোকের অপরদিকে তেমনি গর্বেরও। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা সৈনিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের মায়ের ভাষা। ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের সেই অর্জন শুধু আমাদের মাতৃভাষার প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং সেটাকে ছাপিয়ে পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে স্বাধীন সত্বার এক নতুন স্বপ্নবীজ গ্রথিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের পথের সাহস ও প্রেরণাও যুগিয়েছিল ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের এই মহিমা। যারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের আলো বাতাসে বেঁচে আছি। হাসছি, কাঁদছি। এছাড়াও একুশ আজ আমাদের জন্য পরম গর্বেরও, এজন্য যে তাঁদের ত্যাগের ঐ মহাত্মাকে আমরা আজ বিশ্বের নিপীড়িত হাজারো ভাষাভাষী মানুষের অনুভবের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। বিভিন্ন রূপে, ভিন্ন ভিন্ন রঙ্গে”।

 

ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে ৫ লাখ বছর পূর্বে ভাষার জন্ম হয়েছিলো। ২০ শতকের শেষ প্রান্তে এসে ইউনেস্কো মাতৃভাষা গুলোর অধিকার ও মর্যদা প্রতিষ্ঠার অনন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রতি বছর ১৮৮টি দেশে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস উচ্চারিত হবে। একই সাথে পৃথিবীর বৃহৎ ভাষা গুলোর পাশে ক্ষুদ্র নিপীড়িত ও অবহেলিত ভাষা গুলোও বেঁচে থাকার সুযোগ পবে। তবে বাংলা ভাষা এবং ভাষা শহীদদের ইতিহাস অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব সমগ্র বাঙ্গালী জাতির।

 

তাজবিদুল ইসলাম সিহাব: অর্থ বিষয়ক সম্পাদক, গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (গবিসাস)

 

লেখাপড়া২৪.কম/আরএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট