আগে নিজের ঘর ঠিক কর, তারপর অন্যের…

atik picppআমাদের এই মহান ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতি সত্তা অন্বেষণায় এক চরম সম্ভবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এই ভাষা আন্দোলন জাতিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পথ দেখিয়েছে। আমাদের মঝে স্বাতন্ত্র্য বোধ সৃষ্টি, নতুন চেতনা জাগ্রত করেছে, ভাষাগত ঐক্য, সম্প্রদায়িক ঐক্য সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি আনায়নসহ মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে এদেশের আপামর জনসাধারনকে বিশেষ ভাবে উদ্ধুদ্ধ করেছে। আজ আমাদের চরম গর্বের বিষয় ১৯৫২ সালের সেই ২১ শে ফের্রুয়ারি। আজ সেই মহান ২১ শে ফেরর্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে এটি শুধু বাংলাদেশে নয় পাকিস্তানসহ সারা পৃথিবীতে এই দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। ঐতিহাসিক ২১ শে ফেরর্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বরণীয় করে রাখতে ঢাকায় সেগুন বাগিচায় ১.০৩ একর জায়গার উপরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উক্ত প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠিত এই ইনষ্টিটিউটটি পৃথিবীর সব মাতৃভাষা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু আমরা কি পারছি এর সফল বাস্তবায় করতে।

 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু? আমরা কি পারছি নিজ ভাষার প্রতি সেই শ্রদ্ধা প্রর্দশন করতে। আমরা নিজ ভাষা রেখে বিদেশী ভাষার দিকে অধিক ঝুকছি। আমাদের সন্তানরা আকাশ সংস্কৃতির ও স্যাটেলাইটের প্রভাবে বাংলা ভাষা শুদ্ধ করে বলতে না পারলেও তারা হিন্দি ভাষা ভালই বলতে শিখছে। তারা মিনাকে না চিনলেও তার ডরিমনকে ঠিকই চেনছে। এতে মনে হচ্ছে, আমরা আমাদের ঘর না সামলিয়ে যেন পরের ঘর সামলাতেই অধিক সময় পার করছি, যা কাম্য নয়। যদিও বলতে দুঃখ হয়, আমরা এখনও মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে শিখিনি। রাস্তাঘাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ এমনকি মাদ্রাসার সাইনবোর্ডের দিকে তাকালে সবক্ষেত্রে বাংলার বিপরীতে ইংরেজি ভাষা আবার কোথাও বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত জগাখিচুড়ি বাংলিশ ভাষায় ব্যবহার চোখে পরে। আমরা এতোটাই স্বার্থপর হয়েছি যে, মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে যাঁরা অকাতরে জীবন দিল তাদের কথা আমরা একটি বারও মনে করছি না। মায়ের ভাষা রক্ষায় নিজ নিজ জায়গা হতে আমাদের সকলে ঐক্যবন্ধ হয়ে ভাষা রক্ষায় কাজ করতে হবে। শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চা, গবেষণা এবং আঞ্চলিক ভাষাসমূহ রক্ষাসহ ভাষার আধুনিকীকরণের সুফল সর্বস্তরে পৌঁছিয়ে দিতে আমাদের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। যদিও উক্ত কাজটি শুধু সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়, সর্বস্তরের জনগণকে নিজ নিজ জায়গা ও ভাষার প্রতি ভালবাসার তাগিদে নিজ ভাষা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও দেশীয় সকল প্রকার কাজ-কর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না কি তা নিশ্চিত করতে করতে হবে, যা অধিক জরুরী।

 

সরকারকে সকলপ্রকার অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা ব্যবহারসহ প্রত্যেককে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যানার ও সাইনবোডে বাংলাভাষার ব্যবহার করতে অধিক আন্তরিক হতে হবে। যদিও বাস্তবতা চাকুরির জন্য জীবনবৃত্তান্ত, চাকুরির আবেদন, পত্রপত্রিকায় ও সম্প্রচারিত টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলিতে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠানগুলোতে বাংলা-ইংলিশ মিশ্রিত বিজাতীয় ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে যা দ্রুত পরিহার করে নিজ ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে হলেও শুদ্ধ বাংলাভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করতে অধিক আন্তরিক হতে হবে। মূলত: দেশী সকলপ্রকার কাজকর্মে বাংলা ভাষাকে অধিক প্রাধান্য দিতে হবে। যদিও ভাষার আগ্রাসন, আন্তর্জাতিক ও তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা ইংরেজী হওয়ায় এই ভাষার গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কতটুকু শুদ্ধ করে মাতৃভাষা বাংলা লিখতে ও পড়তে পারছি। যদিও আন্তর্জাতিক ও তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা ইংরেজী হওয়ায় দেশের রাজনীতিবিদ,আমলা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণ ইংরেজি ভাষার দিকে অধিক ঝুঁকছে। আর ইংরেজি জানা শিক্ষার্থীরা তারা একপ্রকার চাকুরী বাজারে এগিয়ে থাকচ্ছে। মূলত: পুঁজিবাদরা আমাদের সন্তানদের এমন এক অসম প্রতিযোগিতায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত আয়ের ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের বাংলা বাদে ইংরেজি মিডিয়ামে শিক্ষা দিয়ে চাকুরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার মত উপযোগি করে গড়ে তুলতে বর্তমান বাজারে একপ্রকার হিমসিম খাচ্ছে। ফলে এইরূপ পরিস্থিতি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা চর্চা ও মানবিক বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বর্তমানে মায়ের ভাষা বাংলা ছেড়ে আমরা ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রতি সকলে যে ভাবে ছুটছি এতে বাংলা ভাষা রক্ষার বিপরিতে বিনষ্ট করার পথ সুগম করছি, যা কখনই কাম্য হতে পারে না। বর্তমানে প্রযুক্তির আর্শিবাদে ইন্টারনেট ও ফেসবুকে বাংলা ভাষার উচ্চারণ ইংরেজিতে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এতে সত্যই আমরা ভীতু-সন্তুপ্ত। মূলত: আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তরুন যুবসমাজকে যে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেই বিষয়গুলো যতদ্রুত সম্ভব ভাবা দরকার।

 

picযদিও দুঃখজনক ভাবে বলতে হয় বর্তমান সময়ে প্রাথমিক শ্রেণীর কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বলতে পারে না ‘শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ কি? কেবলমাত্র তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক অধ্যায়ের বদলতে উক্ত দিবসটি সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পেলেও দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে শহীদ দিবসটি সম্পর্কে কোন অধ্যায় না থাকায় শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে তাদের ধারনা নেই বললেই চলে। উক্ত বিষয়টি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী বলে মনে করি। যদিও বলতে কষ্ট হয়, আমাদের এই মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সুফলগুলো আমাদের মতো সাধারণ জনগণের পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু বর্তমানে মনে হয় এর সুফলগুলো কতিপয় সুবিধাভোগীদের হাতে বন্দি হয়ে পরেছে এ অবস্থা থেকে পরিত্রান পাওয়া জরুরী। কখন কখন মনে হয় আজো যে এই চেতনার সমাপ্তি হয়নি। অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন আমরা দারিদ্রমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধি সোনার বাংলা গড়তে পারিনি।

 

Post MIddle

বিশেষ করে, তরুনদের মাঝে মোবাইল ও ইন্টারনেট ফেইজবুকে অদ্ভুত ইংরেজি অক্ষরে বাংলাভাষা ব্যবহারের প্রবনতা, টেলিভিশন ও বেতারে বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত জগাখিচুড়ি বাংলিশ ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার, ভাষা সাম্রাজ্যবাদের ব্যাচক দাপট, শিক্ষা খাতে এক শ্রেণী পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিকাশ, পুঁজির দুনিয়ায় ভাষাকেও পণ্য বানানোর হীন প্রচেষ্টা, রোগী ইংরেজি জানুক না জানুক ডাক্তার সাহেবের রোগীর ব্যবস্থাপত্র ইংরেজি লিখন, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানে সকল কর্মকান্ড সেই ঔপনিবেশিক ধারাই এখন ইংরেজিতে লিখন, প্রশাসনের উচ্চস্তরের কর্মকর্তাদের মাঝে এখন ঔপনিবেশিক ঘরানার ভুত জেগে থাকা, সর্বস্তরের বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রতি কারো তেমন মাথা ব্যথা না থাকা, ভিনদেশীয় আকাশ সংস্কৃতির অবাধ অনুপ্রবেশ, নিজ ভাষা উপেক্ষা করে ভিনদেশীয় ভাষা ব্যবহারের প্রতি অধিক আগ্রহ, ভাষা র্চচায় ও প্রান্তিক ও আদি নৃগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষায় সার্বিক পৃষ্টপোষকতার অভাবসহ ভাষা জন্য শহীদ মূলত: তাঁদের প্রতি নূন্যতম দায়বদ্ধতা না থাকায় পৃথিবীর অনেক ভাষার মতোই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষার অবস্থাও আজ এাহি এাহি। তাই যতদ্রুত সম্ভব বিরাজমান অবস্থান হতে আমাদের পরিত্রান পেতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরী।

 

আজ আমাদের চরম প্রাপ্তির মাস ফের্রুয়ারি। এই মহান মাসে আমরা চাই ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণা ভুলে সকলেই মাতৃভাষা বাংলাকে সর্বত্র ব্যবহার নিশ্চিত করে ভাষার প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দেবেন। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার সর্বস্তরে ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি আদি নৃগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষায় সার্বিক পৃষ্টপোষকতা সংশ্লিষ্টদের তরফ থেকে প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সকল মানুষকে ভাষা শহীদদের চরম ত্যাগ, সাহসিকতা ও বিরল এই প্রাপ্তির ইতিহাসকে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। যদিও এই কথাটি সত্য কেবলমাত্র ফের্রুয়ারি মাস এলে আমরা ভাষা চেতনায় নতুন করে উজ্জীবিত হই, কিন্তু সারা বছর এই ভাষার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু সেই আত্মোপলব্ধি প্রতি বাংলা ভাষাভাষী মানুষগুলোর মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। এখন জাতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় ও দাপ্তরিক কাজে সেখানে বাংলার পরির্বতে অহেতুক ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে তা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। যদিও বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রতি চরম উদাসীন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই নিজ মাতৃভাষা ভাল ভাবে না জানলে অন্য ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হয় নয়। তাই সবার আগে নিজের ঘর সামলাতে জরুরী। যদিও এই ভাষার দক্ষতা অর্জনের উদ্দেশ্য বিশ্ব কবি রবীন্দনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, পরে ইংরেজি শেখার পত্তন’। কবির এই মর্ম কথাটি সকলকে উপলব্ধি করতে হবে।

 

আমরা সেই শুভ দিনটির অপেক্ষায় রইলাম, যে দিনটি প্রতিটি মানুষের ভিতরে নিজ ভাষার প্রতি অধিক ভালবাসা ও ভাষা শহীদদের প্রতি অধিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হবে, এতে অন্তত ভাষা শহীদদের আত্মদান সফলতা পাবে। এবারের ফের্রুয়ারি ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ সকলের শ্লোগান হোক আর নয় ভাষা সাম্রাজ্যবাদের দাপট, চাই মাতৃভাষা তথা রাষ্ট্রভাষা বাংলার সর্বত্র ব্যবহার। বাংলা ভাষার সবত্র ব্যবহারে সকলের অধিক আন্তরিক হবেন এমনটিই প্রত্যাশা করি।

 

 

লেখক:কলামিষ্ট ও লাইব্রেরিয়ান, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি), ঢাকা। atik@buft.edu.bd

 

 
লেখাপড়া২৪.কম/আরএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট