ব্যারিষ্টার রাবিয়া ভূইয়ার বর্নাঢ্য ও কর্মময় জীবন

রাবিয়া ভূইয়া ১৯৪৪ইং সনের ১লা মার্চ ঢাকা জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম আব্দুল হামিদ একজন নাম করা এবং নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের লীডস ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেন তার মা ফিরুজা খাতুন একজন সুশিক্ষিত গৃহিনী ছিলেন। রাবিয়া ভূইয়া ঢাকার বাংলাবাজার গার্লস স্কুল থেকে ১৯৫৮ সনে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৬০ সনে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে লজিক এ ডিস্টিংশন নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট ৯ম স্থান অধিকার করেন এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সনে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে অনার্স এ প্রথম এবং ১৯৬৪ সনে এম এ তে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৬৬ সনে আইন পাশ করে ১৯৬৮ সনে ডিষ্ট্রিক বার এবং ১৯৬৯ সনে সুপ্রীম কোর্টে সনদ প্রাপ্ত হন ১৯৭৩ সনে বার-এট-ল পাশ করে বাংলাদেশে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। Ford Foundation এর Scholarship এ ১৯৭৭ সনে U.K. Durham University থেকেB.C.L. Degree প্রাপ্ত হন। তিনি ০১-০৩-১৯৮৫ থেকে ০৭-০৮-১৯৮৭ সন পর্যন্ত সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রী হিসাবে এরশাদ সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করেন এবং একই সাথে শিশু একাডেমী ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থার honorary চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। চেয়ারম্যানের জন্য নির্ধারিত ভাতাও তিনি গ্রহণ করেন নাই।

১৯৯৬ সনে দ্বিতীয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আমেরিকার lvy leage ইউনিভার্সিটি কর্নেল থেকে Clarke Scholarship   পেয়ে এল. এল. এম এবং পরবর্তীতে ২০০৭ সনে ডক্টরেট ডিগ্রী (Ph.D) অর্জন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রীমে কোর্টে আপীলেট ডিভিশন এ সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে নিয়োজিত আছেন। ব্যারিষ্টার এট-ল পড়ার জন্য তার স্বামী ব্যারিষ্টার মোজাম্মেল হক ভূইয়া প্রখ্যাত ভ্ইূয়া একাডেমী ( UK Law Education Tutorial Institute) প্রতিষ্ঠাতা করেন। রাবিয়া ভূইয়া বর্তমান চেয়ারম্যান। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়নমূূলক সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। এছাড়া বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ও ওম্যান ফর ওম্যানের সদস্য এবং Bangladesh Legal Aid and Services Trust (BLAST) এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং বহু মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত। এছাড়া আইনজীবী হিসাবে বহু ব্যাংক এবং বিভিন্ন কর্পোরেশন এর লিগ্যাল এডভাইজার. উল্লেখ্য যে, ব্যারিষ্টার রাবিয়া ভূইয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ব্যারিষ্টার।

মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অবদান
১৯৭১ সনে তিনি ইংল্যান্ডের লিংকনস ইন স্টুডেন্ট ইউনিয়নে নির্বাচন করে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এ সময় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। তখন তিনি লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান নিয়ে মিটিং, মিছিল এ অংশ গ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা ও তহবীল সংগ্রহ করার ব্যাপারে বিভিন্ন মুক্তিয্দ্ধু সংগ্রাম কমিটির সাথে কাজ করেছেন এবং জনাব সুলতান শরীফের সাথে বিভিন্ন দূতাবাসে যান। বঙ্গবন্ধু এবং ড. কামাল হোসেন জানুয়ারীতে পাকিস্থান থেকে লন্ডনে পৌছলে তাকে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সদস্যগণ, তিনি তার স্বামী এ.কে.এম মোজাম্মেল হক ভূইয়া সহ বিমানবন্দর থেকে তাদের receive করে Claridge হোটেলে নিয়ে আসেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে অনেক কথা হয় এবং অনেক সময় কাটান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সনে বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য জিল নাইট পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রনে বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং পাকিস্তান সরকারের স্বপক্ষে বক্তব্য দেন, যার ফলে লন্ডনে বাংলাদেশীগণ তার উপরে ক্ষেপে ছিলেন। জিল নাইট ইংল্যান্ডে ফিরে পাকিস্তান Embassy এর উদ্যেগে বাংলাদেশের উপর বক্তব্য রাখার জন্য লিংকনস ইনে সমাবেশ করার অনুমতি পেলে সাথে সাথে রাবিয়া ভূইয়া মিটিং বন্ধ করার জন্য লর্ড জাস্টিস রাসেলের কাছে যান। লর্ড জাস্টিস রাসেল বলেন লিংকনস ইনের প্রেসিডেন্ট সর্ব দলীয় ছাত্রের প্রতিনিধি, তাই শুধু বাংলাদেশর পক্ষে কথা বলতে পারবেন না এবং মিটিং বাতিল করা যাবে না। তিনি বলেন আমি প্রথমে বাংলাদেশী তারপরে প্রেসিডেন্ট। এ মিটিং হলে আমি পদত্যাগ করব। তার এই কথা শুনে লর্ড জাস্টিস রাসেল মিটিং বাতিল করে দেন। যার ফলে পাকিস্থান Embassy এর লোকজন এবং ছাত্ররা তাকে খুব harass করে। এ সব বিভিন্ন ঘটনা তৎকালীন মুক্তিয্দ্ধু আন্দোলনের সচিত্র প্রতিবেদন লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে Delegates আসলে তিনি বাংলাদেশে genocide এর ঘটনা তুলে ধরে স্মারকলিপি বিলি করেছেন। এসব বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য তিনি সময় মত পড়াশুনা শেষ করতে পারে নাই। পাকিস্তান Embassy থেকে পাসপোর্ট বাতিল করলে ব্রিটিশ সরকার থেকে থাকার অনুমতি পান।

বাংলাদেশ হবার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে BCL করার জন্য WAR & WANT FUND থেকে রাবিয়া ভূইয়ার জন্য সরকার ৫০০ পাউন্ড এর Cheque পাঠান সেটা রাবিয়া ভূইয়া তদানিন্তন হাইকমিশনার সৈয়দ সুলতান সাহেবের নিকট ফেরত দেন এই বলে যে, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ অনেক কষ্টে আছে, এ টাকা তাদের প্রাপ্য। আমার পড়াশুনা তাদের জীবনের চেয়ে বড় নয়।” পরবর্তীতে, লর্ড জাস্টিস রাসেলের সহায়তায় তিনি UK Royal Court Service এ join করেন কিন্তু চাকুরী করে পড়াশুনা করা সম্ভব ছিল না বলে ১৯৭৩ সনে ঢাকায় চলে আসেন এবং আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন, ১৯৭৬ সনে Ford Foundation Scholarship নিয়ে UK থেকে BCL Degree নেন।

আইন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান
একজন সফল ও সৎ আইনজীবী হিসাবে রাবিয়া ভূইয়া সর্বজন পরিচিত। মন্ত্রী হবার পূর্বে এবং পরে তিনি সুপ্রীমকোর্টের সর্বোচ্চ আদালত (আপীল বিভাগে) বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী মামলা করেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য — জমিলা খাতুন বনাম রুস্তম আলী, ফলে মহিলারা এখন অতীত ভরনপোষন পাচ্ছে, যা আগে পেতনা এবং হেফজুর রহমান বনাম সামসুন্নাহার যাতে তিনি তালাকপ্রাপ্ত মহিলাদের জন্য খোরপোষ চেয়েছিলেন এবং আপীল বিভাগ এ নিয়ে অনেকদিন মামলা চলে এবং তৎকালীন সকল নামকরা আইনজীবী এবং মানবাধিকার সংগঠন তাতে অংশ গ্রহণ করে। আর একটি যুগান্তরকারী মামলা মমতাজ বেগম বনাম আনোয়ার হোসেন। তিনি জনপ্রিয় কন্ঠ শিল্পী রুনা লায়লা, চিত্রাভিনেতা ববিতা, রোজী সামাদ এবং দিতীর পারিবারিক মামলা করেন। সাভারের পক্ষঘাত গ্রস্থদের পূনর্বাসন কেন্দ্রের (CRP) প্রতিষ্ঠায় ওনার স্বামীর সাথে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তিনিই প্রথম পার্লামেন্টে ১৯৯৭ সনে নারীদের জন্য ১/৩ সিট সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের দাবী সম্বলিত বিল আনয়ন করেন, তাতে তিনি তার দল থেকে (জাতীয় পার্টি) বা পার্লামেন্ট থেকে সমর্থন পান নাই। এ কারণে ২০০১ সনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

Post MIddle

মন্ত্রী হিসাবে কি কি করেছেন
০১-০৩-১৯৮৫ থেকে ০৭-০৮-১৯৮৭ পর্যন্ত সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে অনেক যুগান্তরকারী পদক্ষেপ ও সংস্কার মূলক কাজ করেন। তিনি বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক conference এ যোগদান করেছেন। পার্লামেন্ট এ থাকাকালীন বাংলাদেশ পার্লামেন্ট এবং UNDP ( Institute of Parliamentary Studies) যৌথ উদ্যোগেWomen,  Democracy and Parliament নামে গবেষনা মূলক বই লিখেন। ৭ম পার্লামেন্টে ( জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার সময়) থাকা কালীন তিনি অল্প সময়ের জন্য স্পীকারের দায়িত্ব ও পালন করেন। ১৯৮৫ সনে নাইরোবিতে World Conference on UN DELADE OF WOMEN “ অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ delegation নেতৃত্ব দেন এবং Leticia Shahani (Un Assistant Secretary General) এর পরে তিনি Conference এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তার চেষ্টার ফলে জাতি সংঘের ফান্ড যেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির উন্নয়নে বেশী ব্যবহৃত হয় সে রকম একটি ধারা সংযোজন হয়।

মন্ত্রী থাকাকালীন সর্ব প্রথম মহিলা অধিদপ্তরের সর্ব্বোচ্য পদগুলিতে মহিলা অফিসার নিয়োগ এবং মন্ত্রনালয়ের প্রথম মহিলা জয়েন্ট সেক্রেটারী নিয়োগ করেন।তিনি একাধিকবার জাতি সংঘের General Assembly এবং কমিটি গুলিতে অংশ গ্রহন করেছেন এবং কমিটি অন দ্যা ষ্টেটাস অব ওম্যান এ চেয়ারম্যানের জন্য প্রতিযোগীতা করেন কিন্তু President Ershad এর অনুমতি না পাওয়াতে in absentia প্রতিযোগীতা করেন এবং মাত্র ২ দুই ভোটের জন্য হেরে যান।

তার সংস্কারের মধ্যে সর্ব প্রথম মহিলা অধিদপ্তরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল গঠন, পতিতা মেয়েদের পুনর্বাসন ও কর্ম সংস্থানের জন্য NORAD এর সাহায্যে সর্ব প্রথম একটি সামাজিক প্রতিবন্ধী ও পূনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রে সংস্কার, মুক ও বধির ব্যক্তিদের জন্য Hearing Aid, মীরপুরে এতিম ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা কেন্দ্র স্থাপন এবং শিশু একাডেমীতে অডিটোরিয়াম ও যাদুঘর প্রতিষ্ঠা উল্লেখ যোগ্য। তার সক্রীয় সহায়তায় মহিলাদের জন্য যুগান্তকারী আইন Family Court Ordinance ১৯৮৫ সনে প্রনয়ন করা হয়, যার ফলে অতি অল্প টাকায় মহিলারা ভরণপোষনের মামলা করতে পারে। সমাজ সেবামুলক কাজে তিনি মাদার টেরেসার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন এবং একসাথে কাজ করেন।

এছাড়া এলাকার মানুষের উপকারের জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে সোনারগাওয়ের নয়াপুর নিয়ে যান এবং সোনারগাও সহ পাচঁটি উপজেলার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান আমলের রেল লাইন তুলে রাস্তার ব্যবস্থা করেন। যে রাস্তাটি এখন এশিয়ান হাইওয়ে রোড এর অংশ এবং অত্যন্ত ব্যস্ত জমজমাট রাস্তা। এছাড়া এলাকাতে ৭২ ঘন্টার মধ্যে বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করেন যা কিংবদন্তির মত মানুষের মুখে মুখে। এ ছাড়া বাবার নামে সোনারগাওযের নানাখীতে এতিম খানা ও আলীম মাদ্রাসা নিজস্ব জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন এবং নানাখীতে নিজ জমি ও ভবনে ব্যারিষ্টার রাবিয়া ভূইয়া মডেল স্কুল ও কলেজ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন, যার পিছনে নারায়নগঞ্জ জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সর্বত সহযোগীতা করেন।

রাবিয়া ভূইয়া IDR নামে Legal Aid স্থাপন করেন এবং অনেক দরিদ্র মক্কেল বিশেষ করে মহিলাদের আইনগত সহায়তা করেছেন। ১৯৯২ সালে জাপানী টেলিভিশন NHK ‘ ASIA’S WHO IS WHO উপরে রাবিয়া ভূইয়ার সামাজিক ও মানবাধিকার কর্মকান্ডের উপর একটি Documentary Film তৈরী করে, যা সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। এ ছাড়া তিনি ওম্যান ফর ওম্যান এর সাবেক প্রেসিডেন্ট, Bangladesh Alliance for Women Leadership (BDAWL) এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের প্রাক্তন এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এর প্রাক্তন সদস্য।

তিনি International Visitor’s Program এর একাধিকবার USA ভ্রমন সহ European Communities Visitors Program এর স্পেশাল আমন্ত্রনে ইইসি পার্লামেন্ট সহ ৫টি দেশ ভ্রমন করেন।

নারী অধিকার, গনতন্ত্রের উপরে তিনি অনেক বই, আর্টিক্যাল লিখেছেন এবং বর্তমানেও লেখা অব্যাহত আছেন তার লেখা বই এর মধ্যে- GENDER & TRADITION MARRIAGE & DIVORCE (An analysis of Muslim & Hindu Women in Bangladesh) প্রকাশ করেছে UNESCO । বইটি Internet এ Amazon এ পাওয়া যায়।

পছন্দের আরো পোস্ট