কঠিন কাজকে সহজ করে নিতে চেষ্টা করি

সৈয়দা শাহনেওয়াজ শিল্পী, ডাক নাম এ্যানী। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকপাড়া গ্রামে। বর্তমান সময়ের সবচে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্সার নিরাময়ে প্রতিষোধক তৈরী ও রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস এ শীর্ষ পর্যায়ে কর্মরত আছেন। কমার্শিয়াল ম্যানেজারের মত জটিল পদে একজন নারী হিসেবে তিনি ইতোমধ্যে বেশ সফলতা দেখিয়েছেন।সংসারের সবদিক সামলিয়ে অফিসিয়াল কাজে বিদেশ ও ঘুরে এসেছেন অনেকবার। ব্যক্তিগত জীবনে স্বমী ও এক মেয়ে সন্তান কে নিয়ে বসবাস।আমাদের আজকের আয়োজন তাকে নিয়েই।সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমাদের সিনিয়র প্রতিবেদক স্বর্ণক শাহী

শৈশব

পিতা: মরহুম সৈয়দ শাহ্জাহান মাতা: লাভলী বেগম আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। আমি আমার জীবনে বাবাকেই Inspiration মনে করি। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমার কষ্টার্জিত ও সাফল্যমণ্ডিত পজিশনের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে আমার বাবা ও মায়ের। আজও মনে পড়ে যখন ছোট ছিলাম হয়তবা প্রথম শ্রেণি অথবা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তাম, প্রায় সময় না খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম কারণ আমি জানতাম বাবা প্রতিরাতে অফিস থেকে ফিরে আদর করে ঘুম থেকে উঠাবেন, কোলে বিয়ে হাটবেন আর ভাত খাওয়াবেন।

এই লোভে দেখা যেত প্রায়ই এই কাজটা করতাম। আবার আরও একটা কাজ করতান যেমন বাবার কাছে টাকা জমাতাম কিন্তু ফেরত নেওয়ার সময় ডাবল টাকা নিতাম, আর বলতাম, বাবা টাকাগুলো মনে হয় ডিম দিয়েছে। মনে পড়লে এখনো প্রচণ্ড হাসি পায়।

প্রায় সময় যখন আমার পরীক্ষা থাকত, বাবা ভোরবেলা ডেকে দিত, চা বানিয়ে দিত, বাবার সাথে বসে আড্ডা দেওয়া, ঘুরতে যাওয়া খুব মিস করি। সবচেয়ে বেশী মিস করি বাবার কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শোনা।

বাবা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলতেন, তখন অবাক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মা-একজন সাদাসিধা মানুষ। গৃহিণী, বাড়ির কাজ করতেই সবচেয়ে বেশী পছন্দ করেন।

স্বপ্ন ছিল

ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার। মানুষের সেবা করা। বাবা সবসময় বলতো, জীবে প্রেম করে যেইজন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর”। কিন্তু সরকারী কোন মেডিকেল কলেজে চান্স না পেয়ে, বাবার কথামত বেসরকারি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসী বিভাগে ভর্তি হই। ফার্মেসী বিভাগটা মেডিসিন রিলিটেড ছিল তাই পড়াশুনা করতে ভালই লাগতো।

ছন্দপতন

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়া অবস্থায় হঠাৎ করে বাবা স্ট্রোক করে ইন্তেকাল করেন। মনে হল,মাথার উপর আকাশ ভেংগে পড়লো। বটগাছের মত কি যেন একটা সরে গেলো! বড় ভাই দেশের বাইরে থাকতেন, ছোট বোন তৃতীয় শ্রেনিতে পড়তো,স্বভাবতই আমার উপর সমস্ত দায়িত্ব চলে আসে।

এদিকে মা আস্তে আস্তে বাবার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একই সময় সমস্ত চাপে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। বাবা সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা হওয়ায় পেনশনের কিছু টাকা দিয়ে সংসারই ঠিকমত চলতো না, তার উপর আমার পড়াশুনা।

Post MIddle

কিন্তু বাবা ছিল আমার আদর্শ, তার স্বপ্ন কিছুতেই নষ্ট হতে দিবো না, তাই টিউশনি, পার্টটাইম জব সব মিলিয়ে সংসার এবং আমার পড়াশুনা চালাতাম। সেই দিনগুলো আমার স্পষ্ট মনে পড়ে।। যখন খুব কষ্ট লাগতো, শুধু বাবার ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, মনে হত বাবা আমাকে দেখছেন এবং সাহায্য যোগাচ্ছেন। পৃথিবীর এই প্রতিকুল পরিবেশের সাথে লড়াই করতে তখন থেকেই বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই হয়তবা যেকোনো কঠিন কাজকে আজও সহজ করে নিতে চেষ্টা করি।

কর্মজীবন

২০০৯ সালে অনার্স কমপ্লিট করার পর BEACON PHARMA তে জয়েন করি সিনিয়র অফিসার হিসেবে। দীর্ঘ নয় বছর পার করছি এখানে। প্রথম প্রথম সব কিছু এত সহজ ছিল না, খুব ভয় লাগত সাপ্লাইয়ারদের সাথে কথা বলতে। বিদেশী সাপ্লাইয়ারদের সাথে মিটিং করতে। কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্ট চালাতে।

সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস

এক্ষেত্রে যিনি আমার সাহস যুগিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, যেকোনো ডিসিশন নিতে সাহায্য করেছেন, যার অক্লান্ত পরিশ্রমে আজকের এই বিকন ফার্মা, তিনি আমার শ্রদ্ধেয় MD স্যার। আজকের এই পথ চলার সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকার দাবিদার। তিনি সবসময় বলেন, তুমি তোমার লক্ষ্য ঠিক রাখো, আল্লাহ তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। আমার স্বামী বাপ্পী সবসময় বলে, কোনকিছুই অসম্ভব না। অফিসের কাজে প্রতি বছর ৩-৪ বার দেশের বাইরে যেতে হয়, যেমন: ভারত, চীনা, ইউরোপ ন প্রথম প্রথম যেতে খুব ভয় লাগতো। কিন্তু বাপ্পী আমাকে সর্বোপরি সাহস দিয়েছেন। বলেছে, এটা তোমার কাজ সেটা দেশে হোক আর বিদেশে, কাজের প্রতি সততা থাকলে সবই সম্ভব।

সৈয়দা শাহনেওয়াজ শিল্পীভালোলাগার কেন্দ্রবিন্দু

আমার আজ এই অবস্থানের পেছনে আমার অফিস সহকর্মীদের ভূমিকাও অপরিসীম। তারা প্রতিনিয়ত আমাকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। সর্বোপরি, একজন-যে আমার জীবনের আলো, আমার একমাত্র মেয়ে “বর্ষা”-প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। অফিস থেকে আসার সাথে সাথে বলবে- “মা, মা! আজকে কয়টা মিটিং করেছো? ” আমি কিন্তু বড় হয়ে তোমার মতো অফিস করব। কলিংবেল টিপে বলবো, “আমাকে একটু হরলিক্স দাও তো”- হা হা হা। সমস্ত ক্লান্তি তখনি দূর হয়ে যায়।

প্রিয়

প্রিয় রঙ: গোলাপি । পোশাক : সালোয়ার-কামিজ । খাবার: ছোট মাছ,শুটকি ভর্তা । গান: পুরাতন বাংলা গান । ব্যক্তিত্ব : বঙ্গবন্ধু ও বাবা ।

আদর্শ

আমার আদর্শ আমার MD Sir। বাবার মেয়ে হিসেবে যতটা গর্ববোধ করি, আজকের এই অবস্থান নিয়ে যতটা গর্ববোধ করি, তার চেয়েও বেশি গর্ববোধ করি একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হিসেবে।

পছন্দের আরো পোস্ট