ল্যাপারোস্কোপির ব্যবহার ও সফলতার গল্প

মোহাম্মদ হামিদুল হকঃ

রাশিয়ার মস্কোতে গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে People’s Friendship University অনুষ্ঠিত হয়ে গেল Science For Health কর্তৃক আয়োজিত ১০ম আন্তর্জাতিক সাইন্টিফিক সম্মেলন ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জারি অলিম্পিয়াড।

এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রাশিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের  প্রায় ৩৬ টি দেশের দুইশতাধিক শিক্ষার্থী  অংশ গ্রহণ করার সুযোগ পায়।এই আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ করেন রাশিয়ার তুলা স্টেট ইউনিভার্সিটির মেডিসিন অনুষদের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী  মোঃ মাহমুদুল হাসান।তিনি সার্জারি অলিম্পিয়াডের ল্যাপারোস্কপিক সেকশনে তৃতীয় স্থান অর্জন করে নিজের মেধার পরিচয় তুলে ধরেন।

তিনি পর্যায়ক্রমে মোট তিনটি  রাউন্ডে ১২৫ নম্বরের মধ্যে ১১৫ নম্বর  অর্জন করতে সক্ষম হন। যথাক্রমে ১১৮ নম্বর নিয়ে  দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন রাশিয়ার গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম বর্ষের ছাত্রী এলিজাবেথা গরুজদেভা এবং ১২০ নম্বর নিয়ে ১ম স্থান অর্জন করেন কাজান স্টেট মেডিকেল ইনিভার্সিটির ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী আলেকসি জের্তসালোভ।

সম্মেলন শেষে মাহমুদুল হাসান সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন National Research Nuclear University তে অধ্যায়নরত মোহাম্মদ হামিদুল হকঃ

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্মেলন গুলোতে ছোটবেলা থেকেই আমার তীব্র আগ্রহ ছিল অংশগ্রহণ করার, গত বছরে দুইটি আন্তর্জাতিক  সম্মেলনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।কিন্তু এইবারই  প্রথম আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। সত্যি কথা বলতে প্রথম  প্রথম খুবই ভয় ও স্নায়ু চাপ ছিল, কিন্তু পরিবার ও দেশবাসীর ভালোবাসা ও সাপোর্ট নিয়েই অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত  নিই। আপনারা অবহিত আছেন যে,ল্যাপারোস্কপিক মানেই  খুবই সূক্ষতার সাথে যন্ত্রের মাধ্যমে ক্যামেরার সাহায্যে মনিটর দেখে কাজ করতে হয়। তাই ৪র্থ বর্ষের ছাত্র হিসেবে ল্যাপারোস্কোপির ব্যবহার  আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করেছিল।

আমি শুধু অংশগ্রহণ করেছিলাম নতুন কিছু শেখার জন্য এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে , সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ভালো কিছু করার,  কিন্তু কখনো ভাবিনি যে মেধা তালিকায় স্থান করে নিতে পারবো। এরজন্য  আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ।

পিছনের  গল্প

সময়টা ছিল ১০ মার্চ দুপুরে আমি ক্লাসে ছিলাম, হঠাৎ আমার ইনস্টাগ্রামে একটা মেসেজ আসে, আমার এক রাশিয়ান বান্ধবী কাছ থেকে এবং তার মাধ্যমেই আমি প্রথম জানতে পারি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও অলিম্পিয়াডের  বিষয়টি। সে আমাকে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায় ,তার সূত্র ধরেই আমি বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করি এবং অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই।

রেজিস্ট্রেশনের  প্রক্রিয়া

মূলত রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহের  দিকে এবং ২৫ মার্চ পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ ছিল। রেজিস্ট্রেশনের  সকল তথ্য”science4health.org ” ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করি ,  তাদের নির্দেশনা অনুসরণ করি। রেজিস্ট্রেশনের  জন্য  একটি  একটিভ  ই-মেইল আইডি , কিছু  ব্যক্তিগত তথ্য, টেলিফোন নাম্বার , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম , নিজের অনুষদ ,শিক্ষা বর্ষ ও অংশগ্রহণের সেকশন বাছাইকরণের মতো বিষয় গুলো ছিল ।

আর সাইন্টিফিক সেকশনে অংশগ্রহনের জন্য নিজস্ব গবেষণার একটা সারাংশ জমা দিতে হয়েছিল,যা ৩৫০০ শব্দের বেশি নয়।

পরবর্তীতে ১০ এপ্রিল রাতে সকল প্রকার ভেরিফিকেশন  শেষে  আমাকে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে  ই -মেইলের মাধ্যমে দুইটি আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয় , যার মাধ্যমে এই আন্তর্জাতিক আসরে আমার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।

যে কয়টি সেকশনে অংশগ্রহণ

আমার দুইটি সেকশনে  অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। প্রথম সেকশনটি  ছিল Practical Skills Contests : Laparoscopic surgery Olympiad এবং দ্বিতীয়টি ছিল Scientific Sections : Surgery.

কেন ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়া

ল্যাপারোস্কোপির উপরে আমার পূর্বে তেমন দক্ষতা ছিলোনা , তবে ল্যাপারোস্কোপির প্রতি আমার আগ্রহ ও ভালোবাসা সেই মেডিকেল স্কুলের শুরু থেকেই ছিল এবং  সেই আগ্রহ ও ভালোবাসা থেকেই আমার অংশগ্রহণ করা ।উল্লেখ্য, তুলা শহরের স্থানীয় একটি হাসপাতালে আমার প্রাকটিস করার সুযোগ হয়, যেখানে ডাক্তারা ল্যাপারোস্কোপির  সাহায্যে  বিভিন্ন অপারেশন করে থাকেন , সেই থেকেই  আসলে আমার ল্যাপারোস্কোপির প্রতি আগ্রহ এবং আমি শেখার জন্য মনোনিবেশ করি ,যার পরিপ্রেক্ষিতে ,একদিন আমি ৫০০ টাকা দিয়ে একটি  ওয়েবক্যামেরা  কিনে আমার স্যার সহযোগী অধ্যাপক কারাপিষ দিনিস ভ্লাদিমিরোভিচের কাছে গিয়ে ল্যাপারোস্কোপির প্রতি  আমার আগ্রহের কথা প্রকাশ করি  এবং তখন তিনিই আমার আগ্রহ দেখে খুশি হয়ে তার অতিরিক্ত ইন্সট্রুমেন্টগুলো ব্যবহার করার সুযোগ দেন ।

সেই থেকেই প্রাকটিস শুরু করি, পরে ধীরে ধীরে আমার ল্যাপারোস্কোপির প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে , এভাবেই আসলে শুরু করা।

 Scientific Sections সম্পর্কে

সাইন্টিফিক সেকশন  বিভিন্ন পর্বে ভাগ করা ছিল।  যেমন – ব্যাসিক সাইন্স , ইন্টারনাল মেডিসিন , অনকোলোজি, কার্ডিওলোজি , পেডিয়াট্রিক্স , গাইনোকোলোজি , ফার্মেসী , সার্জারিসহ   আরো কয়েকটি । সার্জারি  সেকশনে  পিত্তথলির পাথরের (Acute Cholecystitis)  উপর একটা প্রেসেন্টেশন ও আমার রিসার্চ উপস্থাপন করি।

Post MIddle

উল্লেখ্য , মাহমুদুল হাসানকে নিজস্ব গবেষণা ও প্রেসেন্টেশনের অনবদ্য উপস্থাপনের  জন্য বিচারকমন্ডলী  স্পিকার হিসেবে সম্মানসূচক  সনদপত্র প্রদান করেন।

ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি অলিম্পিয়াড সম্পর্কে বিস্তারিত

অলিম্পিয়াড মূলত তিনটি  রাউন্ডে সম্পন্ন  হয়েছিল এবং প্রতিটি রাউন্ডে ক্লিনিক্যাল প্রমলেম সল্ভের জন্য নির্ধারিত সময় ও নম্বর বরাদ্ধ ছিল। প্রথম রাউন্ডে ২০ টি  ক্লিনিক্যাল কেইস সমাধান করতে হয়েছিল ,যার জন্য সময় ছিল মাত্র ১০ মিনিট।

পরবর্তী ধাপে  ল্যাপারোস্কোপিক রিং বসানোর টাস্ক দেয়া হয়েছিলো, এছাড়াও পরবর্তী রাউন্ডগুলোতে Tying surgical knots, Intracorporeal laparoscopic  suture, Laparoscopic origami এই টাস্ক গুলো ল্যাপারোস্কোপির সাহায্য করতে হয়েছিল।

বলাবাহুল্য, উক্ত অলিম্পিয়াডে রাশিয়ার পাশাপাশি হাঙ্গেরী , গ্রীস ,বেলজিয়াম , সাইপ্রাস , বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা , মক্সিকো , পোল্যান্ড , ইরাক ,  পানামা , নাইজেরিয়া, বেনিন ,সাউথ আফ্রিকা , আফগানিস্থান, ইন্দোনেশিয়া  সহ বিভিন্ন দেশের ৩২ জন  শিক্ষার্থী  অংশগ্রহণ করেন।

অলিম্পিয়াডের জন্য যতদিনের প্রস্তুতি

পুরোপুরি ২৮ দিন।  কিন্তু আমি মনে করি যে, আমি পূর্ব থেকে যে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম  ল্যাপারোস্কোপির  উপরে, তা আমাকে  অনেকাংশে সাহায্য করেছে।

আমি আসলে  প্রতিযোগিতায় বিশ্বাসী নই, সবসময় অন্যদের কাছ থেকে  শিখতে পছন্দ করি, নতুন কিছু শেখার আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করি, এতেই খুব আনন্দবোধ করি।  ফলে হেরে যাওয়ার কোন ভয় থাকেনা। হয় শিখবো না হয় জিতবো। (হাহ …হা….)

ভবিষৎ পরিকল্পনা

পরিকল্পনা  আছে , আগামী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের  ফেব্রুয়ারিতে হাঙ্গেরীতে আন্তর্জাতিক সার্জারি অলিম্পিয়াড ও সাইন্টিফিক কনফারেন্সে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা এবং নিজেকে প্রমাণ করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রিয় বাংলাদেশকে আরো একবার তুলে ধরা।

আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডগুলোতে  অংশগ্রহণেচ্ছুদের জন্য

আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা  অলিম্পিয়াডগুলোতে যাওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টা এবং নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি , বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক মেধাবী পরিশ্রমী ও উদ্যোমী , শুধু একটু পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।

তবে, খুশির খবর এই যে ,  রাশিয়া, সুইডেন , আমেরিকা,কানাডা, ডেনমার্ক , পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, হাঙ্গেরী সহ অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে  বা  অলিম্পিয়াডে বিনামূল্যে  অংশগ্রহণ করা যায়, তার জন্য ইন্টারনেটে  গুগলে সার্চ করার পরামর্শ দিতে পারি, ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন আয়োজক কমিটির সাথে যুক্ত হওয়া , পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর এম্বেসীর ওয়েবসাইটে  এডুকেশন পোর্টালে  অনেক ফ্রি কন্ফারেন্সের  তথ্য পাওয়া যায়।

এছাড়াও একটা ই-মেইল আইডির মাধ্যমে বিভিন্ন আয়োজক কমিটির ওয়েবসাইটে সাবসক্রাইব  করে রাখতে পারেন। ফলে,  যথাসময়ে  বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন  ।

স্বপ্ন

আমি নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে অনেক  ভালোবাসি ,  তারই পরিপ্রেক্ষিতে বলি, সার্জারিতে রেসিডেন্সি করার খুব ইচ্ছা আমার,মহানায়ক উত্তম কুমারের “আনন্দ আশ্রম” সিনেমার মতো একজন বিলেত ফেরত গ্রাম্য ডাক্তার হতে চাই , চিকিৎসা  ব্যবস্থাকে সহজ ও সুলভ করার লক্ষ্যে কাজ  করার পাশাপাশি  বিনামূল্যে সম্বলহীন মানুষদের সেবা করতে চাই।

বলাবাহুল্য , গত ২৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ১০ম আন্তর্জাতিক সাইন্টিফিক সম্মেলন ও ল্যাপারোস্কোপিক অলিম্পিয়াডের  সমাপনী অনুষ্ঠান ,উক্ত সমাপনী পর্বে গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের  মেডিসিন অনুষদের  সহযোগী অধ্যাপক  দিমিত্রি লিয়ানিদোভিচ  তিতারোভ  শিক্ষার্থীদের মাঝে সনদপত্র  ও পুরস্কার প্রদান করেন।

পরিশেষে , আন্তর্জাতিক ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি অলিম্পিয়াডে ৩য় স্থান বিজয়ী মোঃ মাহমুদুল হাসান তার সার্বিক সফলতার জন্য সকলের নিকট ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন এবং দোয়া  চেয়েছেন।

 

লেখক মোহাম্মদ হামিদুল হকঃ  National Research Nuclear University তে অধ্যায়নরত

 

পছন্দের আরো পোস্ট