ফটোগ্রাফি শিল্পের পথিকৃৎ জর্জ ইস্টম্যান

ফটোগ্রাফিকে সহজ এবং সাশ্রয়ী করে তুলে ধরার জন্য জর্জ ইস্টম্যান (George Eastman) কোডাক (Kodak) ক্যামেরা আবিষ্কার করেন। ক্যামেরা আবিষ্কারক সৃজনশীল এই মানুষটিকে নিয়ে আজকের নিবন্ধ।
জর্জ ইস্টম্যান নিউইয়র্কের ওয়াটারভিলে ১৮৫৪ সালের ১২ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮০ সালে তিনি ইস্টম্যান ড্রাই প্লেট এবং ফিল্ম কোম্পানি খোলার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন। ১৮৮৮ সালে প্রথমবারের মতো ইস্টাম্যানের কোডাক ক্যামেরার বিক্রি শুরু হয়েছিল। পরে তিনি শিশুদের জন্য আলাদাভাবে দীর্ঘস্থায়ী ব্রাউনি ক্যামেরা বের করার সিন্ধান্ত নেন। ইস্টম্যানের কোডাক ১৯২৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ক্যামেরা শিল্পে পরিণত করেন।
পরিবার
ইস্টাম্যানের বাবা ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। ইস্টম্যান নামটি তার বাবা কাছ থেকেই পাওয়া। ছোট একটি স্কুলে অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় জর্জ ইস্টাম্যানের স্কুল জীবন। পরবর্তীতে ১৮৬০ সালে তার পরিবার রচেস্টারে স্থানান্তর হলে তিনি বাণিজ্যিক একটি কলেজ থেকে কলেজ জীবন শেষ করেন। ৮ বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। ১৬ বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে তার বড় দুই বোন মৃত্যুবরণ করেন।
শিক্ষা
পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে ১৪ বছর বয়সে জর্জ ইস্টম্যান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে সংবাদ বাহক এবং পরে বিমা কোম্পানিতে অফিস বয় হিসাবে চাকরি শুরু করেন। পরিশ্রমী ইস্টম্যান উচ্চ বেতনের যোগ্যতা অর্জনে নিজের চেষ্টায় অ্যাকাউন্টিং অধ্যয়ন করা শুরু করেন। অবশেষে তিনি রচেস্টার সেভিং ব্যাংকের হিসাবরক্ষক পদে নিযুক্ত হন।
উদ্ভাবন
২৪ বছর বয়সে জর্জ ইস্টম্যান পরিকল্পনা করেন সান্টো ডোমিংগো ভ্রমণের উদ্দশ্যে বের হবেন। একজন সহকর্মীর পরামর্শে তিনি চেয়েছিলেন ভ্রমণের সকল স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করতে। কিন্তু সমস্যা হলো তৎকালীন ফটোগ্রাফির সরঞ্জামগুলো ছিল অনেক ভারী এবং ব্যয়বহুল। কিন্তু আর্থিক এই বাঁধা কৌতূহলী ইস্টম্যানকে থেমে রাখতে পারেনি। মজার বিষয় ফটোগ্রাফির সকল উপরকরণ কিনলেও ভ্রমণে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি সেবারের মতো।
পরবর্তীতে তিনি ফটোগ্রাফিকে সহজ এবং সাশ্রয়ী করার জন্য গবেষণা শুরু করেন। শুষ্ক প্লেট তথা ড্রাই প্লেটকে কিভাবে ফটোগ্রাফির সাথে সংযুক্ত করা যায় এ নিয়ে ভাবতে থাকেন।
কোডাক ফটোগ্রাফি
১৮৮০ সালের এপ্রিল মাসে নতুন ফটোগ্রাফি কোম্পানি শুরু করার পর তিনি ব্যাংকের চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। জর্জ ইস্টম্যান এবং ক্যামেরা আবিষ্কারক উইলিয়াম হল ওয়াকার ছোট এবং সাশ্রয়ী ক্যামেরা বাজারে নিয়ে আশার জন্য একই সাথে কাজ করেন। ইস্টাম্যান মনে করতেন, প্রত্যেকটি পণ্যের নিজস্ব নাম থাকা উচিত। এজন্য তিনি তার আবিষ্কৃত ক্যামেরার নাম দেন ‌’কোডাক ক্যামেরা’। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে জর্জ ইস্টম্যান কোডাক ক্যামেরা চালু করেন। পরবর্তীতে ইস্টম্যান কোডাক নামে তার নিজস্ব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
Post MIddle
কোম্পানীর স্লোগান ছিল “আপনি বোতাম টিপুন, বাকিটা আমরা করি।” এর অর্থ হলো কোডাক ক্যামেরা দিয়ে ১০০ ছবি তোলার পর এটি পুনরায় কোম্পানির কাছে পাঠানো হতো। কোম্পানি ছবিগুলোর যথাযথ উন্নয়নের পর ব্যবহারকারীকে ক্যামেরাটি সহ পাঠিয়ে দিত। এ ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য ১৮৮৯ সালে ইস্টাম্যান কোডাক ক্যামেরার ফিল্ম তৈরির জন্য হেনরি রেইচেনবাখ নামক একজন রসায়নবিদকে নিয়োগ দেন। ফিল্ম তৈরির এই সিন্ধান্ত পরবর্তীতে ইস্টম্যান কোম্পানির অনেক সাফল্য নিয়ে আসে।
ব্রাউনি ক্যামেরা
শখের ফটোগ্রাফার এবং শিশুদের ক্যামেরার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য জর্জ ইস্টম্যান ১৯০০ সালে ব্রাউনি ক্যামেরা চালু করেন যার তৎকালীন বাজার মূল্য ছিল মাত্র ১ ডলার। এছাড়াও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সামরিক বাহিনীর জন্য বিশেষ একটি ক্যামেরার উন্নয়নে কাজ করেন যা বিমান থেকে বিভিন্ন ছবি তুলতে সাহায্য করেছিল। সর্বোপরি, ইস্টম্যানের উদ্ভাবনগুলো ফটোগ্রাফি শিল্পে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে আসছে।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা
ইস্টম্যান তার কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ে ব্যবসা করলেও তিনি খুব বড় মাপের শিল্পপতি ছিলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত শ্রমিকদের মাঝে মুনাফা ভাগাভাগির ধারণাটি বাস্তবায়নের জন্য তিনিই প্রথম আমেরিকান শিল্পপতিদের মাধ্যে এগিয়ে আসেন। এছাড়াও তিনি কর্মীদের উৎসাহ করার জন্য নিজস্ব অর্থায়নে পুরষ্কৃত করতেন বিভিন্ন ভাবে। জর্জ ইস্টাম্যানের মহত্ত্ব নিজের ব্যবসাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কেননা শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (Massachusetts Institute of Technology), রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়(University of Rochester), টুস্কি বিশ্ববিদ্যালয়, হ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঐতিহাসিক ব্লাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্মাণে অবদান রাখেন।
তিনি বলেন, “বিশ্বের অগ্রগতি শিক্ষার উপর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভর করে”। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও তার অবদান অনেক। তৎকালীন সময় রচেস্টার এবং ইউরোপে ডেন্টাল ক্লিনিক নির্মাণ তার উদ্বেগের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তিনি মনে করতেন, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা একটি শিশুর মানবিক বিকাশে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। ধারণা করা হয়, ইস্টম্যান জীবদ্দশায় মানবপ্রেমে তার মোট সম্পদের ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ দান করেন।
জীবনের শেষ সময়
ইস্টম্যান দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ১৪ মার্চ, ১৯৩২ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি নিজেই নিজেকে গুলি করার মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মৃত্যুর আগে তিনি একটি নোট লিখে যান, “আমার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে তাহলে, কেন আর অপেক্ষা করবো?”
অতি দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়া ইস্টম্যান কখনোই বিয়ে করেননি। সঙ্গীত প্রিয় এই মানুষটি ১৯২১ সালে নিউইয়র্কের রচেস্টারে ইস্টম্যান স্কুল অফ মিউজিক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩২ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইস্টাম্যান মৃত্যুর জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
সামগ্রিকভাবে, তিনি জীবনকে নানাভাবে উপভোগ করেছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। নিজের জীবন উপভোগ করলেও তিনি ফটোগ্রাফির মাধ্যমে অগণিত মানুষের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী উপভোগের সুযোগ করে দিয়ে গেছেন। ব্যতিক্রমী এবং অসাধারণ এই উদ্ভাবনী ব্যক্তিত্ব ফটোগ্রাফি শিল্পে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
পছন্দের আরো পোস্ট