বাবা, অামার বাবা

আমি জানি, তুমি ভালো নেই বাবা। আমার সাথে তোমার কথা হয়নি ঢের ৫ বছর। আমি বাড়িতে এলেও তোমার সাথে আর কথা বলিনা। তুমিও বলোনা। হয়ত আমি বলতে চাই, পারিনা; কিংবা তুমি বলতে চাও, পারোনা। শুনেছিলাম, আমি প্রথম যেদিন পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় সেদিন তুমি ভীষণ কান্না করেছিলে, বাবা! ইসস, পুরুষেরাও যে কাঁদতে পারে তা প্রথম তোমার কাছ থেকেই জানলাম। আচ্ছা বাবা, প্রথম বাবা হবার মুহূর্তে কি পুরুষদের কাঁদতে হয়, নাকি অশ্রুর নামে পুঞ্জিত কোনো মহা আনন্দের শিশিরকণা কিংবা হীরার খনি জ্বলজ্বল করে তাঁদের চোখে! জানো বাবা, মা আমায় বলেছিল, আমি যখন ছোটকালে মায়ের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে থাকতাম, তখন নাকি তুমি মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুহূর্তেই আমায় নিয়ে কোথায় হারিয়ে যেতে।
Post MIddle
মা ঘুম থেকে উঠে আমায় না পেয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করত, ছোটাছুটি করত। কী যে ভীষণ ভয় ও শঙ্কায় ঘাবড়ে যেত মা! কিন্তু মা জানত এই পাগালিমটা তুমিই করেছো। মা আমায় প্রায়ই বলত, তুমি নাকি প্রায়ই এমনটি করতে। বাবা, তোমার সেই দিনটির কথা মনে পড়ে? সেই রাতে আমার কী ভীষণ বায়না হল, দই খাবো।

আমায় তুমি কোনো এক দাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলে যেন। দাওয়াতে ভাত-মাংসর সাথে দই দিয়েছিলো খেতে। দই যতটুকু দিয়েছিল ততটুকু খাওয়ার পর আমার আবার দই খেতে খুব ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু যাদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছিলাম, তাদের দাওয়াতের সবটুকু দই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার অবুঝ মনের বায়না আর কান্না তখন থামায় কে! খাবো বলেছি তো খাবোই। তখন রাত প্রায় ২টা বাজে। এত রাতে আমাদের এলাকায় কোনো দোকান খোলা নেই।

কিন্তু আমার চোখের জল তুমি সহ্য করতে না পেরে সেই রাতেই ৫ কি.মি দূরে শহরের এক দোকান থেকে আমার জন্য দই কিনে এনেছিলে। তারপর আমার চোখের জলে তোমার কোমল হাতের আঙ্গুল ছুঁয়ে কী সহজেই আমার কান্না মোচন করেছিলে, বাবা! আমার কেবল মনে হয়, দবাবা, তোমার মতো কেউ আমাকে কখনো বুঝতে পেরেছিলো কি?’ তোমার নাকি বিদেশের সংবাদ মাধ্যম থেকে ফট্রোগ্রাফি নাকি কিসের জন্য বারবার অফারও আসত। কিন্তু তুমি আমার জন্যই নাকি সেখানে যাওনি। তুমি বলেছিলে, তোমার ছেলেকে রেখে কোথাও যাবে না তুমি। সত্যিই কি আমাকে রেখে কোথাও যাওনি বাবা? যাই হোক, আমার জন্য এতটা ত্যাগ তুমি কেন করলে, বাবা! কুড়িটা বছর পর আমি আর তুমি কতই না দূরে থাকি। পড়াশুনার তাগিদে আমায় এখন বাইরে থাকতে হয়।
কিন্তু আমি জানি, এইটা কোনো দূরে থাকা নয়; দূরত্ব কেবলমাত্র আমাদের সরিয়ে রেখেছে, বাবা। আমার প্রতিক্ষণ প্রতিমুহূর্ত মনে হয়েছে আমি যেন তোমার সেই ছোট্ট ছেলেটির মতই তোমার গালে চুমো খেয়ে আদরে-আহ্লাদে তোমার গাল ভরিয়ে তুলছি, তোমার কোলে মাথা রেখে ঘোড়ার পিঠে চড়ব বলে বায়না ধরছি, এইটা-সেইটা কিনে দিতে হবে বলে হাত-পা ছুঁড়ে তোমাকে মারছি, কী ভীষণ মারছি (হা হা হা)! তোমার মনে আছে বাবা, তোমায় না দেখে আমি কখনো ঘুমাতে যেতাম না। তুমি বাইরে থেকে আসতে, তারপর তোমার গাল চুমোয় আর চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে কী এক অব্যক্ত শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তাম। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে সে কী এক বৈষম্যই না আমার! মায়ের গালে যেখানে চারটা চুমো খেতাম, তোমার গালে সেখানে দ্বিগুণ হয়ে আটটা এসে পড়ত। আরও তোমার মনে আছে বাবা, তুমি ঘোড়া হতে, আর আমি তোমার ঘাড়ে চেপে তোমার পিঠে চড়তাম।
আর তুমি ঘোড়ার মত হাটু মুড়ে আমাকে পিঠে করে চড়ে নিয়ে বেড়াতে। আহা! কী মধুর ছিলো সেই দিনগুলো, সেই প্রত্যেকটি মুহূর্ত! আমি কি কখনো আর তোমার সেই ছোট ছেলেটি হতে পারব, বাবা? বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে নাকি ছেলের সাথে বাবার সম্পর্কও দূরে সরে যায়! তাহলে আমাদেরও কি তাই হয়েছে, বাবা? বলো না বাবা, তাই হয়েছে কি?
সূর্য অস্ত যাবার সময় এসেছে দিগন্তে। কোলাহলপূর্ণ চারদিক নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া। হাস্যোজ্জ্বল গোধূলি এখন তমসাচ্ছন্ন অন্ধকারকে ভালোবেসে তার গায়ে ঢেলে দিয়েছে আবিরের ফোয়ারা। ওইদিকে রংধনুর সাতটি রঙ ছেয়ে দিয়েছে ধূসর আকাশের বুক। আমার বুকে খানিকটা তখন শূন্যতা। আমার বাবা ঘুমিয়ে থাকে আমার বুকে।
বাবার সাথে আমার দূরত্বের শূন্যতা মাপতে মাপতে আমিও ভুলে যাই রঙিন আবিরমাখা প্রশান্ত বিকেলের গল্প। এখন প্রায়ই আমার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা, আরেকটিবার আমায় কোলে তুলে নাও; আমি এবার আটটি নয়, ষোলটি চুম্বনের ভারে ভরিয়ে দেবো তোমার গালের সবটুকু আদল। বাবা, কখনো বলতে পারিনি খুব ভালোবাসি তোমাকে। বাবা, লাভ ইউ অ্যা লট।
কোনো সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর তার প্রধান আশ্রয়স্থল হয় মা-বাবা। মায়ের দুগ্ধ পান ছাড়া যেমন শিশু বয়স অকল্পনীয়, তেমনি বাবার স্নেহ-মমতা ছাড়াও শিশু বয়স বড্ড অপূর্ণ ও দুর্ভাগ্যের! একজন মা যেমন তার বুকের দুধ পান করিয়ে, তার স্নেহের আরশতলে রেখে শিশুকে বড় করে তোলে, তেমনিরূপে বাবার ভূমিকাও অগ্রগণ্য। একজন মা কখনোই সন্তান জন্ম দিতে পারে না বাবার অনুপস্থিতিতে। মা-বাবার যুগল মিলনেই সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখে।
একজন মায়ের অবদান যেমন তার সন্তানের জন্য ঈর্ষণীয়, অনুরূপভাবে একজন বাবাও ঘর্মপিষ্ট দেহে, অক্লান্ত অসহ্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তার কলিজার ধন সন্তানের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেবার সংস্থানে পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে। বাবা তার বিনিময়ে কিছুই চায় না। এত কষ্টের পরও যখন বাড়িতে এসে তার সোনামণির হাসি মুখখানা দেখে সমস্ত কষ্টই যেন নিমেষেই ম্লান হয়ে যায় তাঁর।
সন্তানের জন্য কী না করে একজন বাবা! আর বার্ধক্যে সেই সকল বাবার স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমের দুঃসহ সুখালয়ে! সন্তানের জন্য নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে দেয় একজন বাবা, নিজের আনন্দ-সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের আনন্দ-সুখের যোগাড়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে প্রতিটা মুহূর্তে। পৃথিবীর সকল বাবাকে স্যালুট, ভালো থাকুক পৃথিবীর প্রত্যেক বাবা। বাবাদের চরণতলে জন্ম হোক সন্তানের আগামী ভবিষ্যতের আর যেন বৃদ্ধাশ্রমে যাবার আগে নিজের মৃত্যু নিজের চোখেই দেখতে হয় বাবাদের। দবাবা, আমার বাবা’ আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। কেবল শেষবারও বলা হলো না শুধু দতোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা’।
পছন্দের আরো পোস্ট