জন্মদিনের যত ভাবনা

টানা তিনদিন নিউইয়র্কের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কখন ঝিরিঝিরি, কখনবা ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি কিংবা ঝক্‌ঝকে নীল আকাশ উপভোগ করবার সময় কই। রোজ ভোরের আলো ফুটবার আগেই ঘড়ির এলার্মের সাথে শুরু হয় রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা জীবন। ছেলেদের স্কুল, কোচিং, মসজিদ, লন্ড্রি, বাজার… এমন হাজারো কাজ। শেষ কবে ফ্রেশ চা পান করেছি মনে নেই। ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবো, অমনি উপর থেকে কর্তার হাঁকডাক। আমার জামা কই, পেন্টটা খুজে পাচ্ছি না, আফটার শেভ শেষ হয়ে গেছে …। দুটো করে সিঁড়ি ভেঙ্গে দৌড়ে ছুটে আসি।

সব হাতের কাছে এগিয়ে দেই। যদিও জামা, প্যান্ট সবই ক্লোজেটে থরেথরে সাজানো, তবুও চিরাচরিত স্বভাব। ফিরে এসে দেখি চা ঠাণ্ডা পানি হয়ে পড়ে আছে। গরম করে আবার আয়েশি ভঙ্গিতে যেইনা চুমুক দিবো, অম্‌নি ছোট ছেলের ডাক্‌, আমুউউউ রিয়াসাত আমার জুস ফেলে দিসে ! দৌড়ে উপরে যেতেই রিয়াসাত ভীত অপরাধীর মত করে বলে উঠে, সরি আম্মু, ইটস এন এক্সিডেন্ট। সব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে ফিরে আসি যখন, বিষণ্ণ হাহাকারে ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবি, একটি যত্নে তোলা সন্ধ্যা আর ধোঁয়া উঠা এককাপ চা একদিন হবে নিশ্চয়ই।

ছেলেদের হোমওয়ার্ক, বইপড়া, গোসলে পাঠানো, ঠিক সময়ে খাবার খাইয়ে ঘুমাতে পাঠানো, এসব সেরেই বেশ স্বস্তি ! এবার একান্ত কিছু সময়। নিজের বলে দাবি করা সময়। লিখবো, যা মন চায় লিখতেই থাকবো বিরামহীন। কিন্তু চোখ জুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে বসে। আমি পরবর্তী রাত্রির জন্যে অপেক্ষায় থাকি। একটি ক্লান্তিহীন দীর্ঘ রাত্রি।

এমন যান্ত্রিক জীবন তো আর কাটানো যায় না। নিজের কিছু বিনোদন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, হাসি-ঠাট্টাময় সময়ও তো চাই। পরিবার নিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণে, কিংবা কোন সাহিত্য সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে ছুটির দিনে যাওয়া হয় বটে ! কোনমতে তৈরি হয়েই ছুটি গাড়ির দিকে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গরম হবার সময়টুকুতে চুল আঁচড়াই। রেডলাইটে থামলে মাথার উপরে সামনের আয়নায় তাকিয়ে ফেসপাউডার দেই।

গ্রিনলাইট এলে অন্য গাড়ির সাথে গতি মিলিয়ে ছুটি। আবার রেডলাইটে থামলে দু’চোখে আইলাইনার দেই ঝটপট। শেষে অন্য লাইটে থেমে একটু যত্নে ঠোঁটে লিপস্টিক দেই যদিও, ততোক্ষণে পিছনের গাড়ির হর্ন জানান দেয় গ্রিনলাইট এসে গেছে ! একটু স্বস্তিতে সুন্দরভাবে সেজেগুজে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে কোথাও বেড়াতে যাবার দিন, হবে নিশ্চয়ই একদিন।

এতসব ঝক্কি পেরিয়ে অবয়ব জুড়ে একরাশ হাসি ছড়িয়ে সকলের সাথে কুশলাদি বিনিময়, ছবি তোলা, গল্প করা… কেউ জানতেও পারেনা এর পিছনের কঠিন যুদ্ধের গল্পটি। প্রিয়জনদের ঘিরে এমন ভালবাসাময় ব্যস্ততার গল্প আমাদের সকলের। হয়তো কাহিনীটুকু ভিন্ন। তবে এটা তো সত্যি, পৃথিবীতে কারো জন্যেই কিছু থেমে থাকে না। কারো অনুপস্থিতিতে সাময়িক স্থবিরতা দেখা দেয় হয়তো। এটুকুই। তবুও এই সকল ব্যস্ততা নিয়েই মানুষের জীবন, বেঁচে থাকা। সকল ব্যস্ততা শেষে আমরা ফিরে আসি নিজের কাছে, ফেলে আসা অতীতের কাছে। কখনবা নিঃসঙ্গতা কিংবা দীর্ঘশ্বাসের কাছে।

এমনিভাবে একটি করে দিন, মাস, বছর চলে যাচ্ছে জীবনের হিসাব থেকে। একধাপ এগিয়ে যাচ্ছি মৃত্যুর দিকে। আচ্‌মকা একদিন যদি জানা যায় আমার মৃত্যু সংবাদ, ক্ষমা করো সকলে আমার অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটি। কেননা, চলে যাবার দিন, ক্ষণ আমাদের জানা নেই। আসার দিনটি জানা আছে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি। সেদিন আমার জন্মের দিন ছিল।

ভাল থাকুন সকলে।

রিমি রুম্মান। নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

Post MIddle
পছন্দের আরো পোস্ট