অভেদ্য দেয়াল

মেডিকেলে তৃতীয় বর্ষ। ফরেনসিক মেডিসিনের একটা পার্ট পোস্টমর্টেম দেখানো। এটা নিয়ে সবার আগ্রহের শেষ নেই। আমিও বেশ আগ্রহী ছিলাম। এক সপ্তাহ আগে থেকে শুনছি পোস্টমর্টেম দেখানো হবে। আজকে ছিল সেই দিন।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই তড়িঘড়ি করে রেডি হচ্ছি। সকাল সকাল কারেন্ট নাই। জামা আয়রন করতে পারলাম না। অনেক খুঁজে কালো শার্ট টা আয়রন করা পেলাম। মনের মধ্যে একটা কেমন যেন উত্তেজনা। আকাশ মেঘলা,বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ওভাবেই রওয়ানা দিলাম। মেডিকেল জীবনে প্রথম স্বচক্ষে পোস্টমর্টেম দেখার আকুলতা।

কলেজে পৌছালাম। স্যাররা একটু ব্যস্ত বডি ম্যানেজ করার জন্য।দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম, হয়তো এসব দেখে পরে খেতে পারবো না। দুপুর সাড়ে তিনটা। স্যার সবাইকে মর্গে যেতে বললেন। আগ্রহ নিয়ে সবার সাথে মর্গে প্রবেশ করলাম। গায়ে এপ্রোন জড়িয়ে মর্গের যে রুমে পোস্টমর্টেম করা হবে সেখানে উপস্থিত হলাম। বাইরে মৃত ব্যক্তির ক্রন্দনরত আত্মীয় স্বজন। যেটা আমাদের জন্য উৎসাহ সেটা তাদের জন্য এক বিভীষিকা।

রুমে উঁকি দিলাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা রুম। চারদিকে মাকড়শার জালে ভরে গেছে। উপরে তিনটা সিলিং ফ্যান আর দুটো এনার্জি বাল্ব। রুমটার ঠিক মাঝথেকে একটু দুরে একটা বেড। সেখানো সোয়ানো একটা লাশ। লাশটা একটা মেয়ের। আজকেই সকালে হয়তো মারা গেছে। সুইসাইড কেস। বিষ পানে আত্নহত্যা। সকল প্রকার ফরমালিটি শেষ করে স্যার সবাইকে রুমে যেতে নির্দেশ দিলেন। রুমে ঢুকলাম। একটা মৃত দেহ।চারদিকে একঝাঁক তরুন মেডিকেল শিক্ষার্থী। আগেই বলেছি মৃত দেহটটা একটা মেয়ের। বয়স আনুমানিক ২২-২৮ এর মধ্যেই হবে। বিবাহিত ! স্যার প্রাথমিক কিছু প্রশ্ন আর আর পোস্টমর্টেম সম্পর্কে ধারনা দিচ্ছিলেন। ডোম আসলেন। ধারালো এক চাকু দিয়ে মৃত দেহের পোষাক কেটে বডিটা এক্সপোস করলেন। এর কিছুক্ষণ পরে কারেন্ট চলে গেল। বাইরে বেরিয়ে এলাম সবাই। বাইরে থেকেই সব রকম তথ্য এবং প্রয়োজনীয় সব বলে দেয়া হচ্ছিল। কারেন্ট না আসায় মোবাইলের ফ্লাশেই পোস্টমর্টেম করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আবার সবাই রুমে ঢুকলাম। সবার ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বলে উঠলো।

Post MIddle

মৃতদেহের মেয়েটির গায়ের রং ফর্সা। লম্বায় বেশ ভালই। একজন সুদর্শনা মেয়ে দেখতে যেরকম ঠিক সেরকমই দেখতে। কিন্তু মুখে কষ্টের এক করুন ছাপ। নাক নিয়ে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মুখ দিয়ে ফ্যানা ঝড়ছে। ডোম সব মুছে দিলেন। তখন মনে হচ্ছিলো না এটা কোন মৃত মানুষের দেহ। মনে হচ্ছিল কেউ ঘুমিয়ে আছে। ডোম চাচার বয়স ষাটোর্ধ হবে। হাতে ছুরি, চাকু, বাটালি, ব্লেড। এগুলো দেখে মনের মধ্যে কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠলো। ধারালো যে সব যন্ত্র দেখলে আমাদের ভয় লাগে সেই সব যন্ত্রের প্রয়োগ হবে একটা অনুভুতি প্রকাশহীন দেহের মধ্যে। ভাবতেই শরীরের সব লোম দাড়িয়ে গেল। ডোম যথারীতি প্রথমে গলার নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত ব্লেড চালিয়ে দিলেন। সাধারণত গরু ছাগলের চামড়া কাটতেও আমারা অনেক সাবধানতা অবলম্বন করি। কিন্তু এটা তো মানুষ! তারপরও কি নির্দয়তা! বুকের পাজর চাকু দিয়ে কাটা হচ্ছে। এরপর এক এক করে সব অরগান দেখাচ্ছেন। ফুসফুসটা টেনে হিচড়ে বের করা হলো ,হাত ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কিডনি খুঁজে বের করলেন, কলিজাটাও বের করে দেখানো হলো, ভেতরে কি আছে তাও কেটে দেখানো হচ্ছে। আচ্ছা আমার কলিজাটা কেউ এভাবে ধরলে কি চুপ থাকতে পারবো??এরপর দেখালেন হৃদপিন্ডটা, সেটাও কাটা হল । যে হৃদপিন্ড দিয়ে আমরা ভালবাসা, আবেগ,ঘৃণা প্রকাশ করি কই সেখানে তো কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কতটা কষ্ট নিয়ে আত্নহত্যা করেছে সে তারও তো কোন চিহ্ন নেই। শুধু রক্ত আর রক্ত।বেঁচে থাকতে হয়তো যে সামান্য সবজি কুটতে হাত কাটার ব্যথা সহ্য করতে পারতো না সেই যেন আজ দেহের সব প্রত্যঙ্গ কাটার ব্যথা সহ্য করার অসীম ক্ষমতা অর্জন করে নিয়ে নিয়েছে। একটুও বাধা দিচ্ছে না। আমি এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছি। অনুভুতিহীন এক রোবট। রুমের অন্ধকারে কেমন যেন একটা রহস্যঘন পরিবেশ।

এরপর মাথার খুলি কাটার পালা। যখন হাতের মুঠোয় চুল ধরে একটা কাঠের উপরে মাথা রাখছি বিশ্বাস করুন মনে প্রাণে চাইছিলাম আল্লাহ মেয়েটা জীবিত হয়ে উঠুক। বলুক এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। বিধাতা এ কেমন নিষ্ঠুর শাস্তি। এরপর মাথার খুলি কাটার জন্য একটা হাতুড়ি আর একটা ধারালো বাটুলি ব্যবহার করছে ডোম। জোড়ে জোরে আঘাত করছে মাথায়। ঠক ঠক শব্দ বাইরের অরেকদুর পর্যন্ত শোনা যায়। আমি নিশ্চিত বাইরে অপেক্ষায় থাকা ঐ মৃত মেয়েটার বাবা মা যদি জানতো এটা তার মেয়ের মাথা কাটার শব্দ জানি তারা সেটা সহ্য করতে পারতো না। প্রতিটা শব্দ আমার হৃদপিন্ডে রক্তসঞ্চালন আরও বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছিল। একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করছিলাম। আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করছিলাম আমাকে ধৈর্যশীল কর। নিজের চোখের সামনে এমন মর্মান্তিক দৃশ্য মেনে নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল। কতবার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। এর পর ব্রেন কেটে দেখানো হল। মোটামুটি সব কাজ সমাপ্ত।

কিছুক্ষণ আগে যাকে মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে আছে এখন তার ব্যবচ্ছেদ করা দেহটা দেখে চেনার উপায় নেই। কত সুন্দর একটা শরীর ধারালো চাকুর নিচে ক্ষতবিক্ষত! আমার ঘোর কাটলো। তখনও নাক নিয়ে রক্ত ঝরছে, মুখ দিয়ে ফেনা পরছে। চোখে পানি নেই, বেঁচে থাকতে মানুষ কাঁদে কিন্তু মৃতরা তো কাঁদতে পারে না,তাদের চোখের পানি ঝড়ে না । তারপরেও চেহারায় কষ্টের বিভীষিকার যে ছাপ তা আরও প্রকট ভাবে ফুটে উঠেছে । লাশটা আমার সামনে। জানিনা তার বিদেহী আত্মা কি ভাবে আর্তনাদ করছিল। জীবনের এপার এবং ওপার এক অভেদ্য পর্দায় আলাদা করা। ওপার থেকে হয়তো সব দেখা যায়। এপার থেকে কিছু বোঝা যায় না। কষ্টের পরিমাপ করা যায় না।

মর্গ থেকে বেড়িয়ে এলাম। বাইরে তখনও তার আত্মীয় স্বজনের কান্না। বাবা মা নির্বিকার। অধিক শোকে পাথর। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশটা মেঘলা । গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি।আমার শরীরে কালো শার্ট। বুঝে গেলাম প্রকৃতি আমাকে শোক কি তা বুঝতে শেখাচ্ছে। পৃথিবীটা সুন্দর। জীবন টা আরও বেশি সুন্দর। কুৎসিত ঐ আত্মহননের পথ।

রাকিব আহমেদ, তৃতীয় বর্ষ, গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ

পছন্দের আরো পোস্ট