বাংলাদেশকে ভালোবাসি

নাম আমার ইয়েন চিয়াও ইয়েন। জন্ম তাইওয়ানে। সেখানে লিং টং বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে ৬ষ্ঠ সেমিস্টার শেষ করে এখন বাংলাদেশের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ৭ম সেমিস্টারে পড়ছি। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে লিং টং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিনিময় প্রকল্প রয়েছে এবং আমি সেই প্রকল্পের আওতায় এখন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী।

কীভাবে বাংলাদেশে এলাম সেই গল্প বলি। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক ক্লাবে কাজ করতাম। একদিন জানতে পারলাম, বাংলাদেশের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিনিময় প্রকল্প রয়েছে। ভাবলাম, কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এটাই আমার সুযোগ। তাই আর কালক্ষেপণ না করে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে দ্রুত খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম। তারপরপর জানতে পারলাম, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির সুযোগ রয়েছে। তাহলে আর বিলম্ব কেন? দ্রুত আবেদন করে ফেললাম এবং সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে বৃত্তির জন্য নির্বাচিতও হলাম। তারপর খুশির খবরটি জানালাম মা-বাবাকে। কিন্তু বিধি বাম! মা বাবা রাজি না। তাদের ভয়, একা একটা মেয়ে দেশের বাইরে নিরপদ না। কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না। আমি তাদেকে নানাভাবে বুঝাতে শুরু করলাম এবং শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। ঢাকায় আমার মা-বাবার এক বন্ধু প্রায় ১০ বছর ধরে থাকেন। তিনিও তাদেরকে বুঝাতে সাহায্য করেছেন।

যাই হোক, বাংলাদেশে আসার আগে আমি নিজেও গুগলে বাংলাদেশ লিখে সার্চ দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ আসলে কেমন? গুগল আমাকে যা দেখিয়েছিল তাতে আমি কিছুটা দুঃখ পেয়েছিলাম। গুগল কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ও নেতিবাচক তথ্য দেখিয়েছিল। স্বভাবতই আমার মা বাবা আমাকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যাপারে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। তারপরও আমি তাদের সামনে সাহস দেখালাম এবং বললাম, আমি বিশ্বব্যাপী নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাই, এজন্য আমাকে তাইওয়ানের বাইরে যেতেই হবে। তারা শেষমেশ রাজি হলেন।

বাংলাদেশে আসার জন্য আমাকে আগে হংকং যেতে হলো, কারণ তাইওয়ান থেকে সরাসরি বাংলাদেশের ভিসা সরবরাহ করা হয় না। ভিসার জন্য কাগজপত্র তৈরির ব্যাপারে আমার ভাই আমাকে যাবতীয় সাহায্য করেছিলেন। তো, সব প্রক্রিয়া শেষে আমি ভিসা পেলাম বাংলাদেশের যাওয়ার।

বাংলাদেশে যখন পা রাখলাম, নিজেকে খুব একা মনে হলো। এখানকার কাউকে আমি চিনি না। আমার কাছে না আছে বাংলাদেশি মোবাইল সিম, না অন্যকিছু! বুদ্ধি করে বিমানবন্দরের ওয়াইফাই ব্যবহার করলাম। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রায়হান স্যার আমাকে মেসেজ পাঠালেন এবং বিমানবন্দর থেকে আমাকে রিসিভ করলেন। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং তার সঙ্গে ডরমেটরিতে ফিরলাম। পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম এবং ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মাসুম ইকবাল স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি অসম্ভব ভদ্র একজন মানুষ। আমাকে কোর্স সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারনা দিলেন। আমি তিনটি বিষয় বেছে নিলাম যেগুলোর সাথে লিং টং ইউনিভার্সিটির সাদৃশ্য রয়েছে।

এরপরই ঘটল আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ঘটনা। রায়হান স্যার আমার সঙ্গে নাহিদ তাবান্নুন নামের এক শিক্ষার্থীর পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন, এখন থেকে তাবান্নুন আমার নতুন সহপাঠী! সে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাকে ‘হ্যালো, হাউ আর ইউ’ বলে সম্বোধন করল। কিন্তু আমি জবাব দিলাম খুব মৃদুস্বরে। কারণ আমার ইংরেজি বলার দক্ষতা অতটা ভালো ছিল না। যাই হোক, আমরা নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত কথা বলা শুরু করলাম এবং ধীরে ধীরে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। বলতে দ্বিধা নেই, সে এখন শুধু আমার সহপাঠীই নয়, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুও। তার সঙ্গে আমি সবকিছু শেয়ার করতে পারি। আমার যেকোনো সমস্যায় সে এগিয়ে আসে এবং সমাধান করে দেয়। আমরা একসঙ্গে রান্না করি, মুভি দেখি, বাইরে ঘুরতে যাই। আমরা একসঙ্গে প্রথম যে ছবিটি দেখেছি তার নাম ‘ডুব’। এটাই আমার জীবনে প্রথম কোনো বাংলা সিনেমা দেখা। খুবই অসাধারণ ও ব্যাতিক্রম একটা সিনেমা মনে হয়েছে আমার কাছে।

Post MIddle

আমি আমার ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সত্যিই খুব উপভোগ করছি। এখানে আমার অসংখ্য বন্ধু রয়েছে যারা অত্যন্ত হৃদয়বান। যদিও সবাই আমার খুব পরিচিত নয়, তবু তারা যখন ‘হ্যালো’ বলে তখন আমার খুব ভালো লাগে। তখন নিজেকে আর একা মনে হয় না। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস আমি খুবই পছন্দ করি। এখানকার খেলার মাঠ, সবুজ ঘাস এবং গলফ মাঠ সত্যিই বিস্ময়কর।

আমি এখানে তিনটি বিষয় পড়ছি–ফাইন্যান্স, ইংরেজি-১ ও ইংরেজি-২। এখানকার সব শিক্ষক অত্যন্ত সহযোগিতাপরায়ন। আমি যদি কোনো বিষয় না বুঝতে পারি, তারা সেটা বুঝানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন।

আমি ইতিমধ্যে ডিআইইউ বিজনেস ক্লাব, এডুকেশন ক্লাব ও সোস্যাল বিজনেস স্টুডেন্টস ক্লাবের সদস্য হয়েছি। ক্লাবের সদস্যরা লোকবক্তৃতা, উপস্থাপনা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনসহ নানা ধরনের কাজ করে থাকে। সম্প্রতি তাদের সঙ্গে আমি একটি শিক্ষাসফরে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। সেখানে সবুজ প্রকৃতি ও বৃষ্টি দেখে এতোটা আনন্দ পেয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এদেশের বৃষ্টি তাইওয়ান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি শুনেছিলাম, বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক দেশ এবং সেটার প্রমাণ পেলাম যখন পানাম নগর ভ্রমণে গেলাম। সেখানে অনেক পুরণো প্রাসাদ দেখলাম যেগুলোকে ‘রাজবাড়ি’ বলা হয়।

তবে বাংলাদেশের যে জিনিস সবচেয়ে পছন্দ করি সেটা হচ্ছে, মসলাযুক্ত সুস্বাদু খাবার। আমরা তাইওয়ানবাসীরা মসলাযুক্ত খাবারে সাধারণত অভ্যস্ত নই। সেজন্য মাঝে মাঝে এদেশের খাবার খাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। এখানে কিউ কিউ চা পাওয়া যায় যেটা তাইওয়ানে খুবই জনপ্রিয়। এই চা আমি ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু পান করতে গিয়ে দেখলাম, তাইওয়ানের কিউ কিউ চা আর বাংলাদেশের কিউ কিউ চা এক নয়। দুটির স্বাদে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
বাংলাদেশে আসার পর আমার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোটাই বদলে গেছে। এখানে আসার আগে মনে হয়েছিল, দেশটা ভালো না। কিন্তু আসার পর মনে হচ্ছে, আমি আমার জীবনের সেরা সময় পার করছি। এখানে আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। এখন বাংলাদেশকে মনে হয় আমার দ্বিতীয় বাড়ি। আমি বারবার এখানে ফিরে আসতে চাইব আমার কাছের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমি তাদেরকে অসম্ভব মিস করব। তারা সবসময়ই আমার হৃদয়ে থাকবে।

আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও তাইওয়ানের সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। আমি আমার দেশের মানুষকে উৎসাহিত করব বাংলাদেশে আসার জন্য এবং বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।

আমি ভাবতেই পারি না যে, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে এখানে রেখে যেতে হবে। আমি জানি না ভবিষ্যতে আমাদের আর কখনো দেখা হবে কি হবে না, তবে আমাদের দুজনের স্মৃতি রয়ে যাবে চিরদিন যা কোনোদিন ভুলবার নয়। আমি সত্যিই বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাই বারবার।

ইয়েন চিয়াও উয়েন। শিক্ষার্থী ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

পছন্দের আরো পোস্ট