ঘুরে এলাম প্রাচীন নগরী সোনারগাঁও ও পানামসিটি

প্রতিদিনকার ব্যস্ততা যেন তাড়া করে এই বলে “উঠ ক্লাসে যাওয়ার সময় হয়েছে”। বিষন্ন মন নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে, কখনো নাস্তা করে, আবার কখনো খালি পেটে, ভবিষ্যৎ জীবনের হাত ছাঁনিতে বিভোর হয়ে, ক্লাস, এক্সাম, এসাইনমেন্টে নাকাল হওয়া। তার ফাঁকে আনন্দ ভ্রমন, আর সেটা যদি হয় ডিবেটিং সোসাইটির তাহলে তো আনন্দের শেষ নেই। তার্কিকদের বিতর্কের মঞ্চ ছেড়ে মুক্ত আকাশের নিচে ঘুরাঘুরি আর সেটা যদি হয় দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের মাধ্যমে, তাহলে তো বিতার্কিকদের জ্ঞান ভান্ডারে নতুন জ্ঞানের সঞ্চার।

অনেক কষ্টের পর মিলল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অনুমতি, তার মানে এত দিনকার স্বপ্নের ট্যুর সত্যি হচ্ছে। ভ্রমনের স্থান প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও ও পানামসিটি। তাই তো সবার প্রস্তুতির ব্যস্ততা। ছেলেদের প্রস্তুতির কমতি হলেও মেয়েদের প্রস্তুতির কমতি নেই, আর তা দেখার জন্য ধৈর্য্য ধরতে হল ট্যুর এর দিন পর্যন্ত।

স্বপ্নের ট্যুর বাস্তবায়িত হবে রাত কাটলেই, আর তাই তো ভাবনার কমতি নেই। অবশেষে আজ ট্যুর, সুয্যি মামা উঁকি দেয়ার আগেই আমাদের ঘুম ভাঙল। হাড় কাঁপানো শীত ও চারদিকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পরিবেশকে উপেক্ষা করেই, ফ্রেশ হয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে হাজির। সেখানে কারো উপস্থিতি না পেয়ে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম, বাস যাত্রা শুরু করবে শেরেবাংলা হলের মাঠ থেকে। এখানে এসে ছেলেদের উপস্থিতি টের পেলেও, মেয়েরা অনুপস্থিত। কথা বলে জানা গেল, তারা প্রসাধনী ট্রায়ালে ব্যস্ত, তাই তো এত সময়।

ইতিমধ্যে আমাদের সাবেক অভিবাবক মারুফ ভাই,অর্জুন ভাই,নাসিফ ভাইয়েরা এসে উপস্থিত। আর এতক্ষনেও নারী জাতি ট্রায়াল শেষ করে আসতে পারেনি। অবশেষে অর্ধাঙিনী জাতির শুন্যতা কাটাতে এসে উপস্থিত একঝাঁক তরুনী। দেখে মনে হচেছ কোন নাটকের শুটিং এর মহড়া কিন্তু তা নয় বরং তারা আমাদের ভ্রমন সঙ্গী।

এরই মাঝে অন্যান্য কাজ সেরে ফেলা হল। তাই তো আর দেরী না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে নারায়নগঞ্জের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু। আর এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল গানের তালে নাচার চেষ্টা আর তাই তো নাচের সফলতা না আসলেও আনন্দের খোরাক এর অভাব হয়নি। এরই মাঝে সেরে ফেললাম সকালের নাস্তা। নাচ, গান, হৈ, হুল্লোড়ের ব্যস্ততার মাঝেই পৌছে গেলাম সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প যাদুঘর।

তখন সময় প্রায় এগারটা ছুঁইছুঁই। ভিতরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হল টিকেট প্রাপ্তি পর্যন্ত, অবশেষে ভিতরে প্রবেশ, শুরুতেই অবাক করে প্রাচীন স্থাপনার কারুকার্য আর স্থাপত্য শৈলীর অনুপম নিদর্শন। তাই তো সবাই ব্যস্ত এই নিদর্শনকে ফ্রেমে বন্দী করতে, আর এতেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় কেয়া আপুর। কারন ফ্রেমে বন্দী করার দায়িত্বটা পরে যায় তার উপর। আর পুরো পরিবেশে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে ফুলগাছ ও লতা পাতার সমারোহ। আর একটু সামনে যেতেই দেখা মিলল জাতির জনকের, মনে হচেছ রেসকোর্স ময়দানের ভাষন প্রতিধ্বনিত হচিছল “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ” তাইত অনেকেই এ স্মৃতিকে ফ্রেমে বন্দী করে রাখল।

Post MIddle

এবার যাদুঘরে প্রবেশ, প্রতিটি গ্যালারিতে রয়েছে দুর্লভ সব ঐতিহ্যের নিদর্শন। গ্যালারিগুলো হল- নিপুন কাঠ খোদাই গ্যালারি, গ্রামীন জীবন গ্যালারি, পট চিত্র গ্যালারি, মুখোশ গ্যালারি, নৌকার মডেল গ্যালারি, উপজাতী গ্যালারি, তামা কাঁসা পিতলের তৈজসপত্র গ্যালারি, লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়া মাটির নিদর্শন গ্যালারি, লোকজ অলংকার গ্যালারি, বাশ ও শীতল পাটি গ্যালারি ও বিশেষ প্রদর্শনী গ্যালারি। আর এতে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের অবহেলিত গ্রাম বাংলার নিরক্ষর শিল্পীদের হহÍশিল্প, জন জীবনের নিত্য ব্যবহার্য পন্য সামগ্রী।

এসব শিল্প সামগ্রীতে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের রুপচিত্র ফুটে উঠেছে। ভবনটির সামান্য পূবে রয়েছে লোকজ স্থাপত্য কলায় সমৃদ্ধ ভবনে ‘‘জয়নুল আবেদিন স্মৃতি যাদুঘর”। এতে রয়েছে দুটি গ্যালারি, আর প্রতিটি গ্যালারি আমাদের স্মরন করিয়ে দেয় প্রাচীন জনজীবনের কথা। এছাড়াও আমরা দেখেছি পাঠগার, ডকুমেন্টশন সেন্টার, সেমিনার হল, ক্যান্টিন, কারুমঞ্চ, গ্রামীন উদ্যান, বিভিন্ন রকমের বৃক্ষ, নৌবিহার ও মৎসশিল্পের সুন্দরব্যবস্থা। আর তাইত আমাদের অনেকেই নৌভ্রমনের লোভ সামলাতে পারল না, নেমে পড়ল নৌভ্রমনে। যদি ও অনেকে সাতার জানেনা , এ যেন প্রকৃতির মায়া জীবনের মূল্যকে উদাসীন করে দিয়েছে।

এভাবে ঘুরাঘুরি ও ছবি তোলার ব্যাস্ততার মাঝেই ফিরে যাওয়ার ডাক পড়ল, ততক্ষনে ক্ষুধায় অনেকেই কাঁতর। খাওয়া দাওয়ার কাজটা সেরে ফেললাম বাসে বসেই। এবার যাওয়ার পালা তবে ক্যাম্পাসে নয় আরেকটি দর্শনীয় স্থান পানাম সিটি।

ততক্ষন বেলা ২টা প্রায়। কিছুদূর যেতে ড্রাইভার মামার সংকেত হেঁটে যেতে হবে, রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাবে না। কি আর করার সবাই মিলে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম মসলিনের মূল বাণিজ্য কেন্দ্রে। টিকেট প্রাপ্তির মাধ্যমে প্রবেশের অনুমতি মিলল। শুরুতেই নয়ন কাড়ল সবার, অপূর্ব ও নিপুন কারুকাজ খচিত প্রাচিন সব ইমারতে। সরু রাস্তার দুপাশে অট্রালিকা, সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, মঠ, ঠাকুর ঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর, খাজাঞ্জিখানা, প্রমোদালয়।

আরও দেখা মিলল চারশত বছরের পুরনো মঠ বাড়ি, যার পশ্চিমে রয়েছে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি (নীলকুঠি) পোদ্দার বাড়ি, কাশীনাথের বাড়িসহ নানা প্রাচিন ভবন। এতে মোট বায়ান্নটি বাড়ি আছে। বাড়িগুলোতে স্থাপত্য ঔপনেবিশকতা ছাড়াও মোঘল, গ্রীক, গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারীগরদের শিল্প কুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রন দেখা যায়।

নয়নাভিরাম দৃশ্যের সমাপ্তি না টানতেই ডাক পড়ল আরেকটি সেশনের, সেশনটি ফান বক্স ও নেতার আনুগত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয়, শেষ হয় পুরষ্কার বিতরনের মধ্যে দিয়ে। সেশনটি ছিল নাচ গান কৌতুক ও মজার মজার অভিনয়ে ভরপুর।

ফিরে যাওয়ার পালা, বাসে উঠে আসন গ্রহনের সাথে সাথেই ড্রাইভার মামার যাত্রা শুরু। আর আমাদের সকল কøান্তির ছাপ মুছে মেতে উঠা হৈ হুল্লোর ও নাচ গানে বাদ পড়ল না কেউ, যেন মনে হচেছ নাট্য মঞ্চ। আর এ ভ্রমনটাকে স্মরনীয় করে রাখতেই বিশেষ কিছু করা আর তা ঘটল হাতিরঝিলে এসে সবাই মিলে ফানুস উড়ানোর মধ্যে দিয়ে। আর বাসে উঠে ক্যাম্পাসে রওয়ানার সাথে সাথেই সমাপ্তি ঘটল স্বপ্নের ট্যুর। আর এক অদৃশ্যে মায়ার হাতছাঁনি আমাদের যেন পেয়ে বসেছে। বাস্তবতার কি নির্মম পরিহাস, এই মায়ার জাল যে ছিন্ন করতেই হবে।

পছন্দের আরো পোস্ট