“পেলেনে সিগারেট খাওয়ার শিষ্টেম নাই” জার্নি টু ঢাকা

জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাকে  দেশে যেতে হয়েছিল মায়ের অসুস্থতার কারণে। যদিও হুট করে যাওয়া, স্কুলের শেষ মাসে বাচ্চাদের স্কুল থেকে পারমিশন পাওয়া খুব কঠিন হয়ে গিয়েছিল। স্কুলের প্রিন্সিপাল তো ছুটি দিতেই চাচ্ছিলেন না। দুই তিন দফায় স্কুলে যেতে হয়েছিল। প্রিন্সিপাল মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পারমিশন  দিয়েছেন। আমি ব্লাড প্রেশার ও মাইগ্রেনের রোগী। মায়ের জন্য টেনশন করব — এটাই স্বাভাবিক। প্রিন্সিপালের একটা কথা আমার মনে খুব গেঁথে আছে।
তিনি আমাকে বললেন,  “তোমার মাইগ্রেন ও হাই ব্লাড প্রেশারের কথা বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার ছেলেকে পারমিশন দেব। মাকে দেখতে যেতে না পারলে তোমার মন খারাপ হবে, অসুস্থ হবে। বাচ্চাদের টেক কেয়ার করতে সমস্যা হবে। এতে বাচ্চারা পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে পারবেনা। ওদের রেজাল্ট খারাপ হবে। এইদেশে স্কুলের টিচাররা খুব হেল্প করে। ওদেরকে  অগ্রিম হোম ওয়ার্ক দিয়ে দিল। এছাড়া ইমেইলে কন্টিনিউ যোগাযোগ তো  ছিলই।
সকাল দশটায় জেএফকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিলেন আমার সেজো ভাই। ইমিগ্রেশন অফিসার মার্গারেট আপত্তি তুলল আমার হ্যান্ডব্যাগে দুই পাউন্ড বেশি ওজনের জিনিসপাতি আছে। বাড়তি জিনিস সরিয়ে ওজন এডজাস্ট করতে হল। মার্গারেটের সাথে আমার কাজ  বিশ মিনিট স্থায়ী ছিল। নিজের দায়িত্ব পালন করার ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা হল মার্গারেটের সাথে। এই মুহূর্তে বাচ্চাদের নিয়ে আমার দেশে যাওয়ার খাস কারণ জিজ্ঞেস করল। আমি সেই কথা আওড়ালাম, মায়ের অসুস্থতা। মার্গারেট দুঃখ প্রকাশ করল এভাবে, “আমি গডের কাছে তোমার মায়ের জন্য প্রার্থনা করব। তবে আমার ভাল লাগছে তুমি মাদারল্যান্ডে যাওয়ার এক্সাইমেন্টের মধ্যে আছ।”
বিমানে উঠার পথে যাত্রীদের লম্বা লাইন অনুসরণ করছিলাম। দেখলাম সেই অফিসার হাত নেড়ে সবাইকে হাসিমুখে “Have a safe journey” বলছে। একবুক মিশ্রিত উত্তেজনা নিয়ে একটানা নয় ঘণ্টা জেগেছিলাম। দেখলাম  প্রায় সব যাত্রী আরামের সাথে ঘুমাচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী ওই সময় সবার রাতের ঘুমায়। তাই অস্বাভাবিকভাবে সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। আমি সামনে সিটে অবস্থিত ছোট্ট মনিটরের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছি — প্লেনের অবস্থান দেখছি। দেখলাম ভিয়েনা, মিলান, বার্সিলোনা ও সিরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে গন্তব্যস্থান আবুধাবির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইসলামী টেরোরিস্টদের হাতে নিহত সিরিয়ার নিরপরাধ মানুষগুলোর জন্য কষ্ট হল। নিহত শিশুদের কথা ভেবে বুক চিনচিন করে উঠল।
বলতে গেলে সারাপথ নিদ্রাহীন ছিলাম। কিন্তু এতটুকু ক্লান্তবোধ করিনি। আবুধাবিতে ঢাকার কানেকটিং ফ্লাইটে উঠে কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। গায়িকা ডলি সায়ন্তনীর ভাই গায়ক বাদশা বুলবুল সস্ত্রীক ঢাকা যাচ্ছিলেন। জেএফকে এয়ারপোর্টে তাকে দেখেছিলাম। বুলবুলের সাথে মুখোমুখি দেখা হল ঢাকাগামী ইত্তেহাদে। কুশল বিনিময় করলাম। বাদশা বুলবুল আমার পুত্র কন্যার দিকে তাকাচ্ছিলেন। ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দিলাম এই বলে, “ইনি একজন সুপরিচিত গায়ক। এবং গায়িকা ডলি সায়ন্তনীর ভাই।” আমার সাদাসিধা ছেলেটি দুম করে বলল,  “Who is she? Do I know her?” বাদশা বুলবুল এক মুহূর্তের জন্য বিব্রত হলেন। বিব্রত হলাম আমিও। কিন্তু নিজে নিজে ভাবলাম ডলি সায়ন্তনীকে  আমার ছেলের চেনার কথা নয়। যাই হোক প্লেনে বসে আরাম পেলাম না।
নিউইয়র্ক থেকে সবগুলো প্লেনের সিট লাক্সারিয়াস। কেবিন ক্রুদের সার্ভিসও প্রশংসনীয়। অবশ্য আবুধাবি থেকে যেসব কেবিন ক্রু সার্ভিস দিয়েছে তারাও যথেষ্ট ভাল। একটা বিষয় খুব ভাল করে বুঝেছি,  কেবিন ক্রুদের ধৈর্য থাকতে হয়। ফ্রেন্ডলি নাহলে কেবিন ক্রুর চাকরী করা যায়না। মিডল ইস্ট প্রবাসী ভাইদের ইংরেজিতে অদক্ষতা ছিল বিব্রতকর। এরজন্য তারা দায়ী নয়। সাধারণত দেখা যায় মিডল ইস্টের রাজা প্রিন্স আমীররা ইংরেজিতে একটা বোলও ছাড়তে পারেনা। তারা ইউরোপ আমেরিকায় আসে মাস্তি করতে। টাকা উড়িয়ে যায় বিলাসবহুল হোটেলের সুইটে, বারে। সাথে দোভাষী নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। তাদের দেশে অ্যারাবিয়ান ল্যাংগুয়েজ আর সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ হিসেবে হিন্দি চালিয়ে দিচ্ছে। ভারতের সাথে মিডল ইস্টের দেশগুলোর আমোদ প্রমোদ আর বিলাসিতার সম্পর্ক। ভারতীয় নায়িকাদের জন্য কাতার দুবাই আবুধাবীতে ভোগের পণ্য হয়ে যেতে হয়। এটা মুম্বাই’র নায়িকাদের জন্য বাধ্যতামূলক।
রাজা বাদশা প্রিন্স মীররা ইংরেজি ভাষার অদক্ষতা টাকা দিয়ে  পূর্ণ করে ফেলে। তাদের দেশে শ্রম দিতে যাওয়া আমাদের ভাইরা আরবি এবং হিন্দি শিখে কাজ চালিয়ে দেয়। সেদিনও তেমন ঘটনা ঘটল। ৪৮/৫০ বছর বয়সী একজন ভাই সিটে বসে বিড়িতে আগুন ধরিয়ে টান লাগালেন। দশ বারো হাত দূরে যুবতী কেবিন ক্রু মাথার উপর যাত্রীদের হ্যান্ডব্যাগ অর্গানাইজড করছিল। আমিও হ্যান্ডব্যাগ রাখতে গিয়ে দেখলাম আমার জন্য সংরক্ষিত জায়গা হাবিজাবি মালপত্র দিয়ে ঠাসা। কেবিন ক্রুর সাহায্য চাইলাম। আনাড়ি যাত্রীকে বোঝাতে গিয়ে কেবিন ক্রুকে বেশ ধৈর্যের পরিক্ষা দিতে হল। লোকটাকে বোঝানোই যাচ্ছিল না যে এটা আমার হ্যান্ডব্যাগ রাখার জায়গা। কেবিন ক্রুরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, এইসব যাত্রীরা কখনো নিয়ম মেনে চলেন না। যিনি লাইটার দিয়ে বিড়ি ধরাচ্ছিলেন তার দিকে ছুটে এল যুবতী কেবিন ক্রু “Sir you can’t smoke. Give me your cigarette and gas lighter !” লোকটার মুখ দেখে মনে হল তিনি কেবিন ক্রুর কথা বুঝতে পারেননি। পাশের জন বলল, “ভাই পেলেনে (প্লেনে) সিগারেট খাওয়ার শিষ্টেম (সিস্টেম) নাই।
আপনে ঢেঞ্জারাস (ডেঞ্জারাস) কাম করলেন, দিয়া দ্যান।” খাবার পরিবেশন করার সময় আরেকজন বেঁকে বসলেন। ভাতের সাথে পালক পনির ডাল চিকেন উনার পছন্দই হচ্ছিল না। পালক পনিরকে তিনি ভেবেছেন আলুশাক। খাবার শুঁকে কেবিন ক্রুর হাতে ধরিয়ে দিলেন। তিনি শুঁটকি চাইলেন। কিন্তু সেটা কেবিন ক্রুকে বুঝিয়ে বলতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে শুঁটকিই বলে ফেললেন। প্রবাসী ভাইদের সাথে কয়েক ঘন্টার ভ্রমণে ভালই লাগল। মরুভুমির দেশে শরীরের রক্ত পানি করা পরিশ্রম আর ছুটিতে দেশে স্বজনদের কাছে যাবার অপরিসীম আনন্দ না দেখলে অনুভব করা যায়না। হোকনা তারা ইংরেজিতে দুর্বল, তারা তো আমাদেরই শ্রমিক ভাই।
পছন্দের আরো পোস্ট