ডলারের পিছু ছুটে বেড়াই সন্তানরা চলছে কোথায়..। রিমি রুম্মান

আমার বাড়ির পেছনে যে রেললাইন, সেখান দিয়ে বেশ বিরতিতে এক একটি ট্রেন ছুটে যায় লং আইল্যান্ডের দিকে। রাত যতো বাড়ে, কিংবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে দীর্ঘ বিরতি শেষে নিস্তব্দতার বুক চিরে হঠাৎ হঠাৎ ট্রেন আসে, যায়। রেললাইনের ওপাশে ফোরটি ফোর এভিনিউতে যেতে হলে ছোট্ট একটি ব্রীজ পেরোতে হয়। যদিও ওপথে খুব একটা লোকজন যাতায়াত করে না। কালে ভদ্রে ব্রীজটি পেরোবার সময় আমি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকি। নিচ দিয়ে ছুটে চলা ট্রেন দেখি, কিংবা দূরে রেললাইনের এঁকেবেঁকে মিলিয়ে যাওয়া দেখি। সেই সময় আমার প্রায়ই টিনএজ এক বালিকার কথা মনে পরে, যাকে আমি কোনদিন দেখিনি। পত্রিকায় ছবি দেখেছি কেবল। একযুগেরও বেশি সময় আগে সেই বাংলাদেশী বালিকা লং আইল্যান্ড রেললাইনের উপরের কোন এক ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পরে আত্মহত্যা করেছিলো। এটিই সেই ব্রীজ কিনা, আমি নিশ্চিত নই। তবে অচেনা সেই মেয়েটির কথা মনে হলে সেইসময় আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে।

Post MIddle

নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সেই সময়কার বাংলা পত্রিকাগুলো থেকে জেনেছি, মেয়েটির সাথে তাঁর বাবা-মা’য়ের প্রচণ্ড মতবিরোধ হতো। এদেশে বেড়ে উঠা ভিনদেশি এক প্রেমিক ছিল তাঁর, যা বাবা মা মেনে নিতে পারেনি বরং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্যে তাঁকে চাপ প্রয়োগ করা হত। এতসব মানসিক চাপ, পারিবারিক বিবাদ সবমিলে বিপর্যস্ত মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গত ২রা নভেম্বর আবারো তেইশ বছর বয়সী আরেক বাংলাদেশি তরুণী সেভেনটি ফোর স্ট্রীট সেভেন ট্রেন রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পরে। সামিয়া খান নামের তরুণীটি আত্মহত্যার পূর্বে খালাতো বোনকে ফোনে জানান, ” Now i’m going to be doing some stupid thing.” তাঁর পারিবারিক সূত্রের বরাত দিয়ে একটি পত্রিকা জানায়, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা নিয়ে বাবা-মা’য়ের সাথে সামিয়ার দ্বন্দ্ব লেগে থাকতো বলে সে এস্টোরিয়া’য় খালার বাসায় বসবাস করছিলো। সে ডিপ্রেশনে ভুগছিলো।

গতবছর ডিসেম্বরে আমার বাড়ির অদূরে আরেক বাংলাদেশী টিনএজ ছেলে এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। তার আগে সে মাকে, “Mom, i’m sorry” কথাটি লিখে রাখে টেবিলে। প্রতিবেশীরা বলাবলি করছিল, ভীষণ চাপা স্বভাবের শান্ত এবং ভদ্র ছেলেটিকে প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকতে হতো। মায়ের কড়া শাসনে তাঁর নিজস্ব কোন মতামত কিংবা স্বাধীনতা ছিল না বলে বন্ধুদের হতাশার সাথে জানিয়েছিল হতভাগা ছেলেটি।

এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন ঘটনা আমারই আসেপাশে ঘটছে। ধর্মীয় অনুশাসন হুট করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় না। শিশুকাল থেকেই এর চর্চা করাতে হয়। ভিনদেশে বেড়ে উঠা সন্তানদের শাসন করার ক্ষেত্রে অবিভাবকদেরই গলদ। আমরা আমাদের সন্তানদের দিকে সময়মত মনোযোগী হই না, বেশি বেশি সময় দেই না, তাঁদের বন্ধু হয়ে উঠি না। সকলেই ডলারের পিছু ছুটে বেড়াই। অতঃপর সন্তানরা ভুল করার বয়সটাতে বিপথে গেলে কিংবা ভুল করে বসলে, কঠোর হয়ে উঠি।

পত্রিকায় মেয়েটির ছবি দেখতে দেখতে লালনের সেই গানটির কথা মনে পড়ছে খুব,

“সময় গেলে সাধন হবে না,
তুমি দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন করলে না… “

ভাল থাকুন সকলে।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

পছন্দের আরো পোস্ট