নীল সবুজ পানির মালদ্বীপ যেনো এক খন্ড বাংলাদেশ

liton maldivesনৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, স্বর্গের দ্বীপ, প্রকৃতির কন্যা, সৌন্দর্যের রানী, পৃথিবীর অন্যতম নয়ানাভিরাম ও অপরূপ রূপের দেশ মালদ্বীপ । বিধাতা যেন এখানে দু’হাত ভরে প্রকৃতির রূপে কল্পনাতীতভাবে সাজিয়েছে যা দুনিয়াজোড়া মানুষকে মুগ্ধ করে, টানে । এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের টুনা মাছ পাওয়া যায় বলে মালদ্বীপকে টুনা কন্যাও বলে থাকেন অনেকে। মালদ্বীপের মূল আকর্ষণ হলো এর সরল, শান্ত ও মনোরম পরিবেশ, আদিম সমুদ্র সৈকত এবং ক্রান্তীয় প্রবাল-প্রাচীর । এখানকার সমুদ্রের রং অতি পরিস্কার, পানির রং নীল, বালির রং সাদা। ছোট ছোট দ্বীপগুলো যেন নানান রঙের মাছের একোরিয়াম । জলরাশির দিগন্তজোড়া সমুদ্রবক্ষ, সমুদ্রগর্জন, বায়ু প্রবাহ যেন তাদের নিজস্ব কন্ঠস্বর ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন করে পর্যটকদের অশান্ত মনকে শান্ত করে, হতাশা দূর করে উচ্ছ্বলতা ফিরিয়ে দেয় আর মুগ্ধতায় ফিরিয়ে দেয় মনপ্রান। যারা সমুদ্র পছন্দ করেন, নির্জনতায় হারিয়ে যেতে চান, সমুদ্রের অবগাহনে নিজেকে স্নান করাতে চান, প্রকৃতির সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্যের সূরা পান করতে চান তাদের জন্য মালদ্বীপই হচ্ছে আকর্ষণীয়, প্রিয় ও আদর্শ স্থান।

 

শ্রীলঙ্কা হতে আনুমানিক ৪০০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে ১১৯২ টি ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ । যার মধ্যে ২০০টি বাসযোগ্য । মালদ্বীপের ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন । সংস্কৃত শব্দ দ্বীপমালা শব্দ থেকেই মালদ্বীপ । আবার কারো কারো মতে মালদ্বীপ হচ্ছে দ্বীপরাজ্য । কারো কারো ভাষায় এটি মহল দ্বীপ । মহল অর্থ প্রাসাদ। দ্বাদশ শতক থেকেই মালদ্বীপে মুসলিম শাসন । ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইবনে বতুতা মালদ্বীপ ভ্রমন করেছিলেন । ১১৫৩-১৯৫৩ অবধি (৮০০ বছর) ৯২ জন সুলতান নিরবিচ্ছিন্নভাবে শাসন করেন দ্বীপটি। বিভিন্ন সময়ে পর্তুগীজ, ব্রিটিশ পর্যটক হিসেবে, কখনও কখনও বানিজ্য কুঠি স্থাপন, কখনও ব্রিটিশ সামরিক ঘাটি স্থাপনের জন্য আসে । ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই মালদ্বীপ ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে এবং ১৯৬৮ সালে সালতানাতে মালদ্বীপ থেকে রিপাবলিক মালদ্বীপে পরিণত হয় ।
Maldives Hajj Corporation to develop an Islamic tourism resort

মালদ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার যার শতভাগই মুসলিম। বিদেশীসহ এখনে প্রায় ৫ লক্ষ লোক বসবাস করে যার মধ্যে বাংলাদেশী প্রবাসী রয়েছে প্রায় ৮০ হাজার । যা বসবাসকারি জনসংখ্যার এক নবমাংশ । যাদের অধিকাংশই বয়সে তরুন ও যুবক (২০-৪০ বছর) এবং কর্মঠ। বাসযোগ্য প্রতিটি দ্বীপেই বাংলাদেশী শ্রমিকরা রয়েছেন যারা মাছ ধরা, কৃষি কাজ করা ও ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট মেরামতসহ অবকাঠামো উন্নয়ণে, অফিস-আদালত, দোকান, বাসা-বাড়িতে কাজ, গাড়ী ও ধোনী (নৌকা) চালনা ছাড়াও হোটেল, রেস্তোরা ও রিসোর্টে কাজ করেন । বাংলাদেশী শ্রমিকরাই মূলত: মালদ্বীপের দ্বীপগুলোতে প্রথম কৃষি কাজ শুরু করেন ।

 

মালদ্বিভিয়ানরাও অকপটে স্বীকার করেন যে মালদ্বীপের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অবদান প্রায় ৬০ ভাগ । অধিকাংশ মালিক বাংলাদেশী শ্রমিকদের কর্মকান্ড, সততা ও বিশ্বস্ততায় এতটাই মুগ্ধ যে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সকল দায় দায়িত্ব দিয়ে নি:চিন্তায় থাকেন । অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ব্যবসা বানিজ্য করছেন যার সংখ্যা নিতান্তই কম নয় এবং দিন দিন এর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

 

মজার ব্যাপার হলো দাম্পত্যজীবনে মালদ্বিভিয়ান মেয়েদের কাছে বাংলাদেশী ছেলেরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত। গোলাপের বাগানে যেমন জাতিসাপের মত বিষধর সাপ কিংবা অন্যান্য কীট পতঙ্গও থাকে তেমনি অনেক দুষ্ট প্রকৃতির লোক ও বাংলাদেশী দালালও সেখানে রয়েছে । তাদের মধ্যে অনেকেই মদ, জুয়া, গাজা, হেরোইন, নারী পাচার, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ এর মত ভয়ংকার অপরাধের সাথেও জড়িত। যা বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে শুধু ম্লানই করে না অনেক সময় ইমেজ সংকটও সৃষ্টি করে । এহেনো পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশ সরকারের বিএমইটি, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ দূতাবাসসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে মালদ্বীপে শ্রমিক পাঠানোর সময় আরও সতর্ক হতে হবে ।

Maldives-3

রাজধানী মালে, আধুনিক শহর হলুমালে, হুলহুলে বিমানবন্দর, বিলিংগিলি, ধোনীদো, আড্ডু সহ বড় বড় শহর, হাসপাতাল, অবকাশযাপন কেন্দ্রগুলোতে (রিসোর্ট) বাংলাদেশী শ্রমিকদের আধিক্য । এগুলোর উন্নয়নের সিংহভাগই সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মাধ্যমে। এখানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞসহ প্রায় তিন শতাধিক বাংলাদেশী ডাক্তার কর্মরত রয়েছেন। তাদের অনেকেই পরিবার-পরিজনসহ মালদ্বীপে বসবাস করেন। মালদ্বীপস্থ বিশ্বের সেরা সেরা চেইন অবকাশযাপনকেন্দ্রে বাংলাদেশীরাও কাজ করেন অত্যন্ত সুনামের সাথে। প্রায় ৮-১০ হাজার শ্রমিক অবকাশযাপনকেন্দ্রগুলোতে কাজ করে বিদেশী পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের সুনাম অর্জন করা সহ প্রায় চল্লিশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত মাসিক আয় করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন।

 

Post MIddle

এ ক্ষেত্রে যদি অবকাশযাপনকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সাথে বাংলাদেশ দূতাবাস সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়, তাদেরকে দূতাবাসে বিভিন্ন সামাজিক ও জাতীয় উৎসবে আমন্ত্রণ জানায়, চাকুরী মেলা, সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে বাংলাদেশ থেকে পর্যটন শিল্পের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক নেবার অনুরোধ করে এবং সুন্দরবন, কক্মবাজার, সিলেট, কুয়াকাটাসহ অন্যান্য দর্শনীয় ও মনোরম স্থানগুলো পর্যটকদের জন্য খুবই উপযুক্ত ও আকর্ষণীয়–এ সম্পর্কে তাদেরকে ধারণা দেয়া ও পরিচিত করানো যায় ।

 

যদি পর্যটন খাতে বিনিয়োগের অনুরোধ, প্রশিক্ষণের জন্য কর্মী প্রেরণ ও পর্যটক পাঠানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ, বোয়েসেল ও বায়রাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে একটি সেতুবন্ধন তৈরী করতে সক্ষম হয় তাহলে এদেশ একদিকে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে, সৃষ্টি হবে আরো কর্মসংস্থান অন্যদিকে সেখানে তৈরী হবে আমাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ।

 

রাজধানী মালেতেই বাস করে প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশী । প্রতি শুক্রবার বিকাল বেলায় রিপাবলিক স্কয়ারে (কবুতর পার্ক) ঘটে এদের মিলন মেলা। ছুটির দিনে এয়ারপোর্ট জেটি (ফেরি টার্মিনাল), গোসলপার্ক, কৃত্রিমবীচ থেকে সুনামী টাওয়ার (দরবারুগে) হয়ে ইন্ধিরাগান্ধি হাসপাতালের পেছন পর্যন্ত এবং মাজেদিয়া মাগু (মাগু মানে রাস্তা) সবর্ত্রই প্রবাসী বাঙালিতে গীজগীজ । কখনও কখনও মনে হবে এ যেন বৈশাখী, ঈদ বা বাংলাদেশের কোন জাতীয় উৎসব। ঠিক এমনি ভাবে আড্ডু, বিলিংগিলি, হলুমালে, ধোনীদোতেও ছুটির দিনে তৈরী হয় উৎসবের আমেজ । মনে হয় এগুলো যেন বাংলাদেশের কোন এক সমুদ্র সৈকত।

 

মালে’তে কখনও কখনও বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আবার কখনও কখনও প্রবাসীদের উদ্যোগেও চলে নানান রকমের নাচ-গান, নাটক, যাত্রাপালা, বাউল সঙ্গীত ও ওয়াজ মাহফিল। নীল দরিয়া নামে একটি বাংলাদেশী শিল্পগোষ্ঠেী ও বাংলাদেশ হাইকমিশন’স ইলেভেন নামে ক্রিকেট ও ফুটবল টীম রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সবুজ দল, লাল দল, বি বাড়িয়া, কুমিল্লা ইত্যাদি নামেও ক্রিকেট ও ফুটবলের টীম আছে। মালদ্বীপের মোবাইল কোম্পানীগুলো তাদের বিপণন প্রসারের জন্য ও সরকারি নির্দেশনাসমূহ খুদে বার্তা (মেসেজ) স্থানীয় ভাষা ধিবেহীর পাশাপাশি বাংলায়ও দিয়ে থাকে । বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায়ও বাংলায় লেখা বিজ্ঞপ্তি ও বিজ্ঞাপণ চোখে পড়ে।

Residents-Page-Resized-1000x435
কৃত্রিমবীচে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর ছেলেমেয়েদের জলক্রীড়া (সার্ফিং) এবং যখন সুনামী টাওয়ার ঘেষে বিশাল এলাকা জুড়ে শুরু হয় মায়াবী গোঁধূলী, শুরু হয় সূর্যাস্ত রাতের নিস্তব্ধতা, পর্যটকরা যখন আসে গোসলপার্কে সমুদ্রস্নানে নিজেকে বিলীন করে দিতে নীলাভ প্রকৃতিতে তখনই প্রবাসী বাংলাদেশীরাও মালদ্বীপের লোকাল খাবার কুরুম্বা (ডাব), খিল্লি (পানের খিলি), মলু ভিলা (কাঁচা আম), আমড়া, আরি মলুভিলা গান্ডু (কাঁচা আম, নারিকেল,সুটকী ও তেতুল দিয়ে তৈরী বিশেষ খাবার), শুকনা মাছ ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে সমুদ্রের পাশে ঘাদিয়া (টোং) পেতে বসে যায়। চলে মধ্য রাত অব্দি ।

 

এ যেন আমাদের চেনা অতিপরিচিত কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত কিংবা টিএসসি বা শাহাবাগের আড্ডা স্থল । সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বদুথাকুরুফানু মাগুতে বাবরী দোলানো বাহারি রঙের চুলের স্থানীয় তরুন-তরুনীদের সাথে বাংলাদেশী তরুনদের সমান তালে চলে মোটর বাইক রেস, সমুদ্রের সোঁ সোঁ আওয়াজের সাথে মটর বাইকের ভোঁ ভোঁ শব্দ । সমস্ত এলাকা জুড়েই মনে হয় আমাদেরই সমুদ্র সৈকত- এ সোনার বাংলা – ভারত মহাসাগরের বুকে এ যেনো এক টুকরো বাংলাদেশ ।

 

 

লেখক:মোঃ অহিদুজ্জামান লিটন,সাবেক দূতালয় প্রধান,বাংলাদেশ দূতাবাস, মালদ্বীপ ।

 

 

পছন্দের আরো পোস্ট