বাজেটে কৃষি খাত অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে

Capture

লাল সবুজের বাংলাদেশ কেবল এগিয়ে চলছে না কৃষিতে অতি দ্রæততার সাথে এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ইতিপূর্বে দেশের খাদ্যের চাহিদা পূরনে ব্যর্থ হওয়ার কারনে খাদ্য শষ্য আমদানী করতে হতো। এ আমদানীকারক দেশ এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ । এর পিছনে নায়ক হচ্ছে এ দেশের কৃষি ও কৃষক। তাই কৃষিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে ভাবা যায় না। অথচ গত চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কৃষি খাতে বরাদ্দ কমছে।

 

এই বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে মোট বাজেটের শতাংশ হিসেবেও। ফলে বাজেটে কৃষি খাত অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা না গেলেও আগামীতে কৃষিতেই শুধু নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিসহ জনজীবন বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। দেশের প্রধান এ উন্নয়ন খাতে বাজেটে কেন বিমাতাসুলভ বৈষম্য করা হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়।

 

 
চলতি মাসে ২ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। বাজেটের আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চার বছরের ব্যবধানে কৃষিতে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ তিন হাজার ৯১ কোটি টাকা কমেছে। নতুন অর্থবছর ২০১৬-১৭’তে সংশোধিত বাজেটে কৃষির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। চার বছর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। গেল বছরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা বাজেটে রাখা হয়। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ১০ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের মধ্যে কৃষিতে ছিল ১২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। বাজেটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ৮ ও আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা আরো কমে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের গত সাতটি বাজেটের মধ্যে কৃষি আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছিল ২০১২-১৩ অর্থবছরে। ওই বছর মোট বাজেটের ৮.৫২ শতাংশ ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য। এর পরের বছর তা কমেছে। পাশাপাশি গত ছয় বছরের মধ্যে আনুপাতিক বরাদ্দ হিসেবে এবার কৃষি মন্ত্রণালয়ই সবচেয়ে কম বরাদ্দ পেল। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৭.২৪ শতাংশ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬.৫৮ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬.৪০ শতাংশ।

 

 

২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে ৯ হাজার কোটি টাকা কৃষিতে ভর্তুকির জন্য রাখা হয়েছিল। আসন্ন বাজেটেও এ ভর্তুকি একই রাখা হয়েছে। তবে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরে নিলে চলতি বাজেটের চেয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি কমেছে। আর এ পরিমাণ ভর্তুকি কেবলমাত্র সারের ভর্তুকি খাতেই ব্যয় হবে। আন্তর্জাাতিক বাজারে সারের দাম বেড়ে গেলে কৃষকরা বিপদে পড়বে। গবেষণা খাতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হলেও বাজেটে এ খাতে নতুন করে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এর আগে সরকার কৃষি গবেষণা খাতে ৩৫০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রেখেছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে অনুন্নয়ন খাতে ১৩ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে ভর্তুকি খাতে ৯ হাজার কোটি ব্যয় হবে। চলতি সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। আর প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ১১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। অথচ বিভিন্ন অর্থবছরে রাজনৈতিক আন্দোলন ও প্রাকৃতিক দৃর্যোগ কারণে কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। এখন পাচ্ছে না ধানের ন্যায্যমূল্য। একই অবস্থা গম ও ভুট্টার ক্ষেত্রেও। এবারের বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারণ মণপ্রতি ধান উৎপাদনে স্থানভেদে খরচ হয়েছে ৬৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা। কিন্তু তাকে বিক্রি করতে হচ্ছে ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য ৮৮০ টাকা দরে ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তাতে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার অঙ্গীকার করেছিল সরকার। কিন্তু বাজেটে কৃষকের জন্য তেমন কিছুই করা হচ্ছে না।

 

Post MIddle

 
বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ কম থাকায় কৃষি উপকরণের সাথে উৎপাদন খরচ বেড়েই চলছে। অন্যদিকে, কৃষি পণ্যের দাম কম হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে কৃষি খাত এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অলাভজনক হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। এ জন্য কৃষি উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। ফলশ্রæতিতে একসময় দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। আর খাদ্য সঙ্কট দেখা দিলে বাজারে স্বাভাবিকভাবেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্য সাধারণ ও নিম্নবিত্তের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে স্বাভাবিক জীবনে নেমে আসবে ছন্দপতন। বাড়তে পারে সামাজিক অস্থিতিশীলতা।
আমরা দেখেছি কৃষির উন্নয়ন ঘটলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বা নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। বেকারত্বের সংখ্যা কমে এবং দারিদ্রও কমে আসে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কৃষিখাতের উন্নয়ন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট সফলতা এনেছে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি বিদেশে খাদ্য রপ্তানিও করছে। কৃষি খাতে যদি বাজেট বরাদ্দ বেশি থাকতো তাহলে আমরা মানুষের কল্যাণ সাধন বা উন্নত জীবন যাপনে আরও সফলতা দেখতে পেতাম। এখন আমাদের যে বিষয়টি ভাবা উচিত তা হল- কৃষিখাতে কর্মরত কৃষকদের বয়স দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তরুণরা আর কৃষি কাজে আকৃষ্ট হচ্ছে না। তাছাড়া দুইবছর পর কৃষকদের কাছ থেকে কর নেওয়া কথা ভাবছে সরকার। বর্তমানে চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে যাঁদের বাৎসরিক আয় আড়াই লক্ষ টাকার বেশি, তাঁদের কর দিতে হয়। এ কর আসলে আমাদের দেশের কৃষকরা কত উপযুক্ত বিষয়টি ভাবা উচিত। আর কৃষক যদি করমুক্ত আয় সীমার উপরে ওঠে, তাহলে সেটা অবশ্যই দেশে জন্য মঙ্গলকর।

 

 

আমরা যতি বিগত বছরের বাজেট দেখি, কোথাও বা একটু বাড়ে, কোথাও বা একটু কমে। যেহেতু বাজেট প্রণয়নে আমলারা প্রধান ভূমিকা পালন করে, সেহেতু তারা তাদের স্বার্থের বাইরে বিন্দুমাত্র যেতে চায় না। সুতরাং ব্যবসায়ীদের সন্তুষ্ট রাখা এবং রাজনৈতিক সরকারের ভাগ্য নিয়ন্ত্রন তারাই করে থাকে। সংসদে বাজেট উপস্থাপনের সময় কোন কোন বিষয়ের ওপর অতিরিক্ত কর বসিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করা এবং বাজেট পাশের সময় আবার কর প্রত্যাহার বা হ্রাস করে ফেলে। এতে কারো কারো ভাগ্যোন্নয়ন ঘটে। জনগণও সেই দ্রব্যটির বাড়তি মূল্য দিয়ে চলে। কর প্রত্যাহার বা হ্রাস পেলেও সেই দ্রব্যটির মূল্য কমে না। এই অর্থ খায় কে? আর শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে সামনে রেখে বাজেট তৈরি করা মানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সঙ্গে প্রতারণা করা। অথচ আমার ক্ষেতমজুর ও বর্গাচাষীরা যে পশ্চাদপদ জীবনযাপন করে সেখান থেকে বেরুতে পারার উপায় খুঁজে পায় না। এই অমানবিক বৈষম্য আর কতদিন সহ্য করতে হবে?

 

বিশ্ব ব্যবস্থা এবং বাস্তবতায় কৃষির গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। উন্নত তথা আধুনিক বিশ্ব অতি দ্রæততার সাথে শিল্পে বিশেষ উন্নতি সাধন করছে অথচ জীবন রক্ষায় কৃষিই মূল সহায়ক হিসেবে কাজ করছে । এ বাস্তবতাকে মাথার রেখে প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ বাজেটের ওপর পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ, সংযোজন-বিয়োজনের করে অর্থনীতির মুক্তির সোপান কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হোক।

মো. বশিরুল ইসলাম
কলাম লেখক ও সাংবাদিক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 

লেখাপড়া২৪/এমটি/১৫৮

পছন্দের আরো পোস্ট