বাকৃবিতে শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষে সফলতা

e1adc398-fc3a-469b-9ada-3e798a0b31f9

বোরো ধান চাষে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় ৩-৫ হাজার লিটার পানির দরকার। তাই বোরো মৌসুমে বিদ্যুৎ ঘাটতিও পৌঁছায় চরমে। বেড়ে যায় জ্বালানির চাহিদা। নিচে নেমে যায় পানির স্তর। দেবে যায় ভূমি। মাটিতে বাড়ে লবণাক্ততা, লোহা ও আর্সেনিক। এসব সমস্যা কাটাতে ম্যাজিক পাইপ পদ্ধতিতে বোরো চাষের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পানি সাশ্রয়ের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি গবেষণা কার্যক্রম। ২০০৬ সাল থেকে ‘বোরো ধানে শুকনো পদ্ধতির উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় গবেষণা শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত¡ বিভাগের প্রফেসর ড. মশিউর রহমান। তিনি ও তাঁর গবেষণা দল উদ্ভাবন করেছেন বিশেষ অ্যারোবিক পদ্ধতির চাষ। এতে অর্ধেক সেচেই ফলবে বোরো ধান।

 

 

 
প্রধান গবেষক মশিউর রহমান বলেন, বোরো ধান চাষে প্রতিবছর ভূগর্ভ থেকে বিপুল পানি তুলতে প্রচুর বিদ্যুৎ বা জ্বালানি লাগে। বিদ্যুৎ-ঘাটতির কারণে সেচ নিয়ে কৃষকদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অথচ কম পানিতে চাষ সম্ভব হলে বিদ্যুৎ-ঘাটতি থাকলেও ধান উৎপাদনে সমস্যা হবে না। এই উপলব্ধি থেকে তিনি সর্বপ্রথম গবেষণার কাজ শুরু করেন।

 

 

 

 
ড. মশিউর রহমান আরো জানান, অ্যারোবিক বা শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের জন্য শুকনো জমিতে প্রাইমিং (নির্দিষ্ট সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখা) করা ধানের বীজ নির্দিষ্ট দূরত্বে বপন করতে হয়। পরে প্রয়োজনমত সেচ দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ বপন করা যেতে পারে। নতুন পদ্ধতির জন্য ব্রি ধান ২৯ সবচেয়ে ভাল। তবে বিনা ধান-৬, ব্রি ধান-৪৭ ও ব্রি ধান-২৮ জাতের চাষ করা যেতে পারে। ধানের বীজ প্রথমে ২৪ থেকে ৩০ ঘণ্টা পানিতে ভেজানো হয় এবং পরে ২৪ থেকে ৩০ ঘণ্টা সময়ে ধানবীজের মুখ ফাটা অবস্থা তৈরি করা হয়। আমন ধান কাটার পরে প্রয়োজনমত চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে জমি তৈরি করতে হবে। জমিতে রস না থাকলে সেচ দিয়ে পরে জো অবস্থা তথা উপযুক্ত করে নিতে হবে। হাতে অথবা যন্ত্রের সাহায্যে ২৫ সে.মি. দূরে দূরে লাইন এবং প্রতি লাইনে ১৫ সে.মি. দূরে দূরে ৩ থেকে ৫ সে.মি. গভীর গর্তে ও প্রতি গর্তে ৪ থেকে ৬টি বীজ বপন করা হয়। তবে ধান বপনের মেশিন দিয়ে যদি ধান বপন করা যায় তাহলে মোট খরচের অর্ধেকে নেমে আসবে।

 

6a17de7b-c9b1-41c4-a232-55315ffb75b3

Post MIddle

 
জমির উর্বরতা ও ধানের জাতভেদে সারের মাত্রা নির্ধারিত হবে। গোবর, কম্পোস্ট, টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও দস্তা সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া চার কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। যন্ত্র বা নিড়ানির মাধ্যমে আগাছা দমন করতে হবে। অ্যারোবিক পদ্ধতিতে আগাছার আক্রমণ রোধ করতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে দুই বা তিনবারের বেশি নিড়ানি দিতে হয়। নিড়ানি খরচ বেশি হলেও পানি ও চারা রোপণের খরচ কম লাগে বলে বেশি অ্যারোবিক পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষে বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে। বপনের পরে হালকা সেচ দিতে হবে। এরপর ৬০ থেকে ৭০ দিন পর থেকে প্রয়োজনমত ৭ থেকে ১০টি সেচ দিতে হবে।

 

 

 

 
ড. মশিউর আরো জানান, অ্যারোবিক পদ্ধতিতে বপন থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত খুব অল্প পরিমাণ সেচ লাগে। থোড় আসার সময় থেকে বীজ পুষ্ট হওয়ার সময় পর্যন্ত জমিতে সামান্য পানি রাখা ভাল। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এ পদ্ধতিতে পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণও কম হয়। রোগের আক্রমণ হলে আইপিএম অথবা আইসিএম পদ্ধতি অনুসরণ করে তা দমন করতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অ্যারোবিক পদ্ধতিতে বীজ থেকে চারা হতে ১৫-২০ দিন কম সময় লাগে। তবে চারা রোপণের দিন থেকে ফসল কর্তনে অ্যারোবিক পদ্ধতিতে ১০ থেকে ১৫ দিন বেশি সময় লাগে।

 

 

 

 
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) ও ডেনমার্কের সংস্থা ডানিডার অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের অন্য গবেষকরা হলেন এখলাস উদ্দিন ও মেহেদী মাসুদসহ ১৭ জন শিক্ষার্থী। গবেষণা শুরুর পর গত বছর প্রথম প্রকল্পের অধীনে দিনাজপুর, রাজশাহী, নেত্রকোনা ও টাঙ্গাইলে পরীক্ষামূলকভাবে মাঠ পর্যায়ে শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করে সাফল্য পায়। এ বছর সাতক্ষীরার আসাদুল ইসলাম ১০ কাঠা লবণাক্ত জমিতে এবং দিনাজপুরের সুন্দরবন অঞ্চলে কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগে শুকনো পদ্ধতিতে চাষ করছেন বলে জানা গেছে। মাঠ পর্যায়ে এই পদ্ধতি বিস্তারে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন মশিউর রহমান।

 

 

 

 
দিনাজপুরের সদর উপজেলার কৃষক নুরুল আমিন ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষক গোলাম খায়ের জানান, তাঁরা নতুন উদ্ভাবিত শুকনো পদ্ধতিতে খুবই লাভবান হয়েছেন। এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ খরচ খুবই কম। তা ছাড়া বীজতলা করার ঝামেলা না থাকায় শ্রমিক খরচও কমেছে। একরপ্রতি পাঁচ মণ ধান বেশি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন নুরুল আমিন। আবার একরপ্রতি খরচ কমেছে চার হাজার টাকারও বেশি ।

 

 

 

 
গবেষণা সহকারী মেহেদী মাসুদ বলেন, আমাদের এ গবেষণা দিনাজপুরে প্রায় ৭০ ভাগ সেচ খরচ কমাতে সফল হয়েছে। সারা দেশে এ পদ্ধতির সম্প্রসারণ করলে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ্ সাশ্রয় সম্ভব।

 

 

লেখাপড়া২৪/এমটি/১০২

পছন্দের আরো পোস্ট