হারিয়ে যাচ্ছে শৈল্পিক বাসার কারিগর বাবুই পাখি

318cfb5f-f381-4ce5-a21a-0f24ef9d483f

ছবিঃ সাজ্জাদ সাজু

বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়েঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি ঝড়ে, বাবুই হাসিয়া কহে সন্দেহ কি তায়?, কষ্ট পাই তবু থাকি নিজের বাসায়।

 

 

 

এটি রজনীকানত্ম সেনের বিখ্যাত ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতার চিরচেনা কয়েকটি লাইন। শহরের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া শিশুদের কাছে কবিতাটি অপরিচিত লাগলেও বাংলা মাধ্যমের অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে আজো ফেরে কবিতাটি। কিন্তু কবিতার চিরচেনা বাবুই পাখির স্বাধীনতা আর সুখ দুই-ই আজ হুমকির মুখে। বসবাস উপযোগী পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে শৈল্পিক বাসার কারিগর শিল্পি বাবুই পাখি।

 

 

 

 

আগ্রাসী যান্ত্রিকতা তার শিল্প অহঙ্কার তছনছ করে দিয়েছে। তাকেও চড়াইয়ের মতো আবদ্ধ করেছে অট্টালিকার পরে। তাই হয়ত এখন আর গ্রামের মেঠোপথের ধারে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটির সামনে তার সুরেলা কণ্ঠের কিচিরমিচির ডাক শোনা যায় না। দেখা মেলে না শৈল্পিক বাসায় সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রণয়ের দৃশ্যও।

 

 

7a67f2bd-7b31-4472-b11f-41265f80563c

 

তবে ঢাকার সাভার উপজেলার গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে নলাম ব্রীজ এলাকায়  একটি তালগাছে এদের শতাধিক দৃষ্টিনন্দন বাসা রয়েছে। যা দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং এলাকাবাসী প্রতিদিনই এ এলাকায় ভীড় জমাচ্ছেন।

 

 

 

Post MIddle

কয়েক দিনের টানা  প্রখর রোদের উজ্জ্বলতায় রাঙা প্রকৃতির মতো এরাও মেতে ওঠে প্রাণোচ্ছল উচ্ছ্বাসে।মাত্র এক যুগ আগেও সর্বত্র চোখে পড়ত বাবুই পাখি। এখন আর সারিবদ্ধ তালগাছের পাতায় ঝুলতে দেখা যায়না তাদের শৈল্পিক বাসা। কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয় না গ্রামবাংলার জনপদ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, কীটনাশকের ব্যবহার, শিকারিদের দৌরাত্ব্য, অপিরকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের কারণে এ পাখি বিলুপ্ত হতে বসেছে। তাছাড়া সেই তালগাছের সারিও আজ খুব একটা চোখে পড়ে না।

 

 

 

 

প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের আগ্রাসী কার্যকলাপের বিরূপ প্রভাবেই ওরা হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে দেশের কয়েকটি জায়গায় এখনো হঠাৎ করেই চোখে পড়ে বাবুই পাখির বাসা।

 

 

 

নতুন বাসা তৈরির জন্য অতীতের যাবতীয় দুঃখ  ঘুচিয়ে আনন্দে উদ্বেলিত মনে তারাও পাখা মেলে নীল দিগন্তে। সাধারণত নলখাগড়া ও হোগলা পাতা দিয়ে বাবুই পাখি তার বাসা বুনে থাকে। তবে খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতাও ব্যবহার করে বাবুই। উঁচু তালগাছে তৈরি চমৎকার বাসাগুলো যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়েও টিকে থাকে তাদের বাসা। বাবুই পাখি সঙ্গিনীকে আকৃষ্ট করতে ডোবা, নালা, পুকুরের জলে স্নান করে, এরপর উঁচু তালগাছ, নারিকেল বা সুপারি গাছে বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। বাসা তৈরির অর্ধেক কাজ হলে কাক্সিক্ষত স্ত্রী বাবুইকে ডেকে এনে বাসা দেখায়। তার পছন্দ হলে গড়ে সম্পর্ক। স্ত্রী বাবুইর বাসা পছন্দের পর পুরুষ বাবুই মহাআনন্দে বিরামহীনভাবে বাকি কাজ শেষ করে মাত্র চারদিনে।

 

 

 

স্ত্রী বাবুই ডিম দিলেই পুরুষ বাবুই আরেক সঙ্গী খুঁজতে বের হয়। তারপর আবার বাসা বানানো, আবার ডিম দেয়া, আবার সঙ্গী খোঁজা। এভাবে এক মওসুমে পুরুষ বাবুই সর্বোচ্চ ছয়টি বাসা তৈরি করে। তবে এতে স্ত্রী বাবুইর কোনো আপত্তি নেই। স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। আর তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা ছেড়ে উড়ে যায়। বাবুই পাখি একাধারে শিল্পী, স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি। বাবুই মানুষের মানবিক ও সৌন্দর্যবোধকে জাগ্রত করার পাশাপাশি দেয় স্বাবলম্বী হওয়ার অনুপ্রেরণা। কথিত আছে, রাতে জোনাকি পোকা ধরে এনে সে তার বাসায় রাখে। বাবুই পাখি সাধারণত বিভিন্ন ফসলের বীজ, ধান, বিভিন্ন প্রজাতির পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু ও রেণু প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে। বাবুই পাখি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না।

 

 

 

 

এরা সাধারণত তিন প্রজাতির হয়ে থাকে, দেশি বাবুই (Ploceus philippinus), দাগি বাবুই (Ploceus manyar) এবং বাংলা বাবুই (Ploceus bengalensis)। বর্তমানে মানুষের জীবন যাএার প্রণালী বদলে যাওয়ায় পরিবেশগত বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ফলে পশুপাখি কীটপতঙ্গের মধ্যে নানান ধরনের সমস্যাও দেখা দিয়েছে। অনেকে পারিবারিক প্রয়োজনে সুপারীর গাছ লাগালেও, ইচ্ছা করে তালগাছ লাগায়না ।কারণ এই গাছের ফল অনেক দেরীতে ধরে । এসব কারণে লম্বা গাছের অভাবে বাবুই পাখি সহ অনেক পাখি।

 

 

 

 

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী  মিষ্টি রহমান বলেন, বাবুই পাখির গোশত সুস্বাদু হওয়ায় এক শ্রেণীর অসাধু শিকারি বাসা ভেঙে পাখি ধরে নিয়ে যায়। এ কারণেই বাবুইর সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

 

 

 

 

এরা সাধারণত বিভিন্ন ফসলের বীজ, ধান, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু ও রেণু প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে। দেশের সর্বত্রই এক সময় বাবুই পাখি ও তার দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত বাসা দেখা যেত। তাল জাতীয় গাছে এ পাখি বাস করতো। গাছ কমে যওয়ায় বাবুই পাখির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়াই বাবুই পাখি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। তাই বাবুই পাখি ও তার বাসা টিকিয়ে রাখতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

 

লেখাপড়া২৪/এমটি/১০১

পছন্দের আরো পোস্ট