নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবতী মনে করি: ফারজানা ইয়াসমিন

farjanaদৃঢ় মনোবল, বুদ্ধি, মেধা, সাহস আর ধৈর্য নিয়ে যে কোনো প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে চলা সম্ভব, কাজ শেষে সফলতা আসবেই- বললেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রথম নারী ‘ডেপুটি রেজিস্ট্রার’ (যুগ্ম জেলা জজ) ফারজানা ইয়াসমিন।

 

ফারজানা ইয়াসমিন ঢাকা জজ কোর্টে সহকারী জজ হিসেবে ২০০৮ সালের ২২ মে যোগদান করেন। ২০১২ সালে সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। বাংলাদেশের নারী বিচারকদের মধ্যে তিনি প্রথম যিনি ইন্টারন্যাশনাল ওমেন জাজেজ গ্র্যাচুয়েট ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০১২-১৩ পেয়ে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের গোল্ডেন গেট ইউনিভার্সিটি থেকে পরিবেশ আইনে এলএলএম ডিগ্রি লাভ করেন। একই সময়ে তিনি আমেরিকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশ নেন। শিক্ষাজীবনে ক্রমাগত ভালো ফলাফলের জন্য তিনি প্রথম আলো, শিক্ষা বিচিত্রা, ডিসিসিআই, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা পেয়েছেন। এ বছরেরই আগস্ট মাসে তিনি যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান।

 

কর্মক্ষেত্রে কখনও জেন্ডার বৈষম্য কিংবা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, কখনও কাজের ক্ষেত্রে এরকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হইনি। বরং জ্যেষ্ঠ এবং একই র‌্যাংকের সহকর্মীদের কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। সব সময় কাজের একটি সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি। এদিক থেকে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবতী মনে করি। আমাদের দেশে মেয়ে এবং ছেলের মধ্যে বৈষম্য শুরু হয় পরিবার থেকে। কর্মক্ষেত্রের মতো পরিবারেও নিজেকে বিকাশ করার পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। এরপরও শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে কখনও ছোটখাটো কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে তা নিজ মেধা, বুদ্ধি এবং ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছি। সব সময় যে জীবনে সফলতা আসবে তা নয়, বরং কিছু কিছু ব্যর্থতা থেকেও আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। অপ্রাপ্তি থেকেই বড় কোনো প্রাপ্তির প্রেরণা জোগায়।

 

আমি দেখেছি, আমারই কোনো বোন কিংবা বান্ধবীর অপরিণত বয়সে বিয়ে হয়ে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেউবা সংসারের স্বার্থে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বখাটের হাত থেকে রক্ষা পেতে স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। সে সব দেখে তাদের জন্য কষ্ট পেয়েছি। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি, সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে, তাদের অধিকারের জন্য কাজ করতে হলে আমাকে তৈরি হতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলাম। তাদের প্রতিনিধি হয়ে এখন আমি নারীকে এগিয়ে নেয়ার কাজ করছি। তাদের জীবন থেকেই শিক্ষা নিয়েছি, আমাদের সমাজের নারীরা এগিয়ে চলবে সামনের দিকে।

 

Post MIddle

ফারজানা ইয়াসমিনের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঝিনাইদহে। বাবা শেখ মো. সাবদার হোসেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সরকারি কর্মকর্তা, মা সালেহা সাবদার গৃহিণী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি মেজ।
তিনি ঝিনাইদহের কাঞ্চননগর মডেল হাইস্কুল থেকে ১৯৯৯ সালে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ঝিনাইদহ সিটি কলেজ থেকে ২০০১ সালে মানবিক বিভাগে সাতটি বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে যশোর বোর্ড থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে আইন বিষয়ে এলএলবিতে স্নাতক এবং ২০০৬ সালে ‘আন্তর্জাতিক ও তুলনামূলক আইনে’ এলএলএম ডিগ্রি লাভ করেন।

 

যুগ্ম বিচারক হওয়ার পেছনে পারিবারিক সহযোগিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাবা-মা-ভাইদের সহযোগিতায় আজ আমি ফারজানা ইয়াসমিন হতে পেরেছি। পরীক্ষার সময় খেতে ইচ্ছে করত না। মা মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, বাবা চুলের বেণী করে দিতেন, ভাইয়া ওড়নায় সেফটিপিন মেরে দিতেন, আর এক ভাইয়া রিকশায় করে আমাকে পৌঁছে দিতেন। একজন আইনজীবী ও গবেষকের সঙ্গে আমার বিয়ে হলেও তার কাছ থেকেও সব রকমের সহযোগিতা পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি। ২০১২ সালে আমি যখন ইন্টারন্যাশনাল ওমেন জাজেস গ্র্যাচুয়েট ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০১২-১৩ পেলাম তখন আমার ছেলের বয়স মাত্র এক বছর। ছেলেকে রেখে আমি পড়তে যাব কিনা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আমার মা আমাকে ছেলেকে রেখে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছিলেন না। আমার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে দিলেন আমার স্বামী। তিনি আমাকে উৎসাহিত করলেন, সুযোগটা হাতছাড়া না করার।

 

তার অনুপ্রেরণা, সহযোগিতায় মন থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেরে ফেলে পড়তে চলে গেলাম সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ায়। এক বছর পর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলাম। আমার স্বামী এবং পরিবারের সহযোগিতা না পেলে এক বছরের ছেলেকে রেখে কিছুতেই আমার পড়তে যাওয়া হতো না। জীবনের স্বপ্ন, প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির কথা মনে এলেই প্রথমে বাবা-মার মুখটা ভেসে ওঠে। বাবার হাত ধরেই স্বপ্ন দেখা শিখেছি। বাবা বলতেন, ‘দেখ মা সব মেয়েকেই প্রাকৃতিক নিয়মে বিয়ে হয়, ঘর-সংসার হয়, কিন্তু নিজস্ব পরিচয় থাকে না। আমি চাই আমার মেয়ে এমন হয়ে বেড়ে উঠবে, যার নিজস্ব পরিচয় থাকবে।’ বাবার সেই কথা মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল। নিজের পরিচয় তৈরি করার পেছনে তাই পরিবারের ভূমিকা যে কতখানি তা নিজেকে দিয়ে অনুভব করি। মাদার তেরেসার একটি উক্তি আমাকে সব সময় আলোড়িত করে। ‘লাইফ ইজ টু প্রিসিয়াস, ডু নট ডেসটরি ইট।/ লাইফ ইজ লাইফ, ফাইট ফর ইট।’ এ উক্তি শুধু আমি কেন পৃথিবীর সব নারীর এগিয়ে চলায় পাথেয় হবে।#

 

লেখাপড়া২৪.কম/আরএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট