বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়!

National-Universityওয়েবমেট্রিকসের র‌্যাংকিংয়ে দেশে পঞ্চম। অধিভুক্ত কলেজগুলোয় পড়াশোনা করে ২১ লাখেরও বেশি ছাত্রছাত্রী। উইকিপিডিয়ার পরিসংখ্যানে ছাত্রছাত্রীর দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয়। পেয়েছে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এত এত ছাত্রছাত্রী নিয়েও কিভাবে এত অর্জন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের?

 
দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ এটিই। অধিভুক্ত কলেজগুলোয় পড়াশোনা করে ২১ লাখেরও বেশি ছাত্রছাত্রী। ছাত্রছাত্রীর দিক থেকে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি ছাড়া এর চেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। এমন পরিসংখ্যান উইকিপিডিয়ার। স্প্যানিশ ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের বিশ্বব্যাপী পরিচালিত ওয়েবমেট্রিকস র‌্যাংকিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এগিয়ে আছে কেবল বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডভিত্তিক ইউরোপ বিজনেস অ্যাসেম্বলি।

 

যাত্রা শুরু যেভাবে: ১৯৯২ সালে ৬৪০টি সরকারি-বেসরকারি কলেজ নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। বর্তমানে অধিভুক্ত কলেজ ও বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলে এর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার ২০০টি। এর মধ্যে ২৮০টি সরকারি ও এক হাজার ৯০০টি বেসরকারি। শিক্ষকসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৪ ধরনের ডিগ্রি দেওয়া হয়। এ জন্য বছরে নিতে হয় অন্তত ১০০ ধরনের পরীক্ষা। ২০১৪ সালের স্নাতক (পাস) পরীক্ষায় অংশ নেয় চার লাখ ৭৬ হাজার শিক্ষার্থী। গত ১৯ ডিসেম্বর প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষায় দুই লাখ ৬১ হাজার ৪৪৬টি আসনের বিপরীতে ভর্তীচ্ছু পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৭ জন। সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কলেজ। খরচও কম। উচ্চশিক্ষা তাই কারো জন্যই বাধা নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পড়াশোনা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিদ্যাপীঠ না থাকলে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী।’

 

 

প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ: ড. হারুন-অর-রশিদ জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশজুড়ে বিস্তৃত, বৃহত্তম ও বহুমাত্রিক একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তাই ছয়টি বিভাগীয় শহরে (বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম) স্থাপিত আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো জনবল নিয়োগ, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে সক্রিয় ও গতিশীল করা হয়েছে। পরীক্ষাসামগ্রী বিতরণ থেকে শুরু করে অনেক কাজই এখন করা হচ্ছে গাজীপুরের পরিবর্তে এসব কেন্দ্র থেকে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ অনেক সহজ করেছে।

 

 

ক্র্যাশ প্রোগ্রাম ও একাডেমিক ক্যালেন্ডার: সেশনজট দূর করা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীরা যাতে চার বছরে অনার্স ও তিন বছরে ডিগ্রি পাস করতে পারে, সে জন্য পরীক্ষার অগ্রিম সময়সূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এখন থেকে যারা ভর্তি হবে তাদের ক্ষেত্রেও কোনো সেশনজট থাকবে না। বিভিন্ন বর্ষের পুরনো শিক্ষার্থীদের সেশনজট দূর করতে চালু করা হয়েছে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। সকালে ক্লাস, বিকেলে পরীক্ষা। ক্লাসের সময় ৪৫ মিনিট থেকে বাড়িয়ে ১ ঘণ্টা করা হয়েছে।

 

আগে পরীক্ষার ফল প্রকাশে সময় লাগত ছয় থেকে আট মাস, এখন তা করা হচ্ছে তিন মাসে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সব কোর্সের ক্লাস, পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ হচ্ছে যথাসময়ে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আর কোনো সেশনজট থাকবে না বলে ঘোষণা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের।

 

 

কল সেন্টার ও ওয়ানস্টপ সার্ভিস: শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অন্য সেবাগ্রহীতারা যাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারেন, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষামূলকভাবে কল সেন্টারের মাধ্যমে তথ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ০৯৬১৪-০১৬৪২৯ নম্বরে ফোন করে প্রয়োজনীয় তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে যে কেউ জানতে পারবেন। গাজীপুর ক্যাম্পাসে চালু করা হয়েছে ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার। সেন্টার থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁদের বিভিন্ন সনদ, নাম সংশোধন, মাইগ্রেশনসহ বিভিন্ন সেবা নিতে পারেন। ফি জমা দেওয়ার জন্য ব্যাংকের শাখায় ছুটতে হয় না, রয়েছে আলাদা কাউন্টার।

Post MIddle

এটিই একমাত্র উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে সকালে ফরম পূরণ করে ফি জমা দিলে দুপুর ২টার মধ্যে সনদপত্র, ট্রান্সক্রিপ্ট ও নম্বরপত্র পাওয়া যায়।

 

ই-ফাইলিং: ম্যানুয়াল ফাইল চালাচালি পদ্ধতির পরিবর্তে ই-ফাইলিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ফাইল অনুমোদন করা হচ্ছে এ ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ফলে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে গতির বৃদ্ধি পেয়েছে, নিশ্চিত হয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।

 

 

ভর্তি পরীক্ষার সমন্বিত পদ্ধতি: খুলনার সরকারি বিএল কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মহসিন মিঞা মনে করেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে একটি দারুণ দৃষ্টান্ত হতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এবার সারা দেশে সুশৃঙ্খলভাবে চার লাখেরও বেশি ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা মেধাক্রমের ভিত্তিতে ভর্তি হয়েছেন অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে। ওঠেনি কোনো প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ। প্রতিবছরই সারা দেশে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয় এ বিদ্যাপীঠ। মেধা ও পছন্দক্রম অনুসারে ভর্তির সুযোগ পায় ছাত্রছাত্রীরা।

 

নতুন নতুন বিষয়: স্নাতক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীর জন্য চালু করা হয়েছে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ শীর্ষক আবশ্যিক কোর্স। সম্প্রতি কলেজ পর্যায়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, মিউজিক, অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড এভিয়েশন সায়েন্স ও এভিয়েশন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে অনার্স এবং থিয়েটার স্টাডিজে চালু করা হয়েছে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘জাতীয় চাহিদা ও উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে সংগতি রেখে নতুন নতুন বিভাগ চালু করা হবে।’

 

শিক্ষক প্রশিক্ষণ: আগে নিয়মিত না হলেও এখন বছরে এক হাজার ২০০-র বেশি শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। প্রতি মাসে তিন বিষয়ের ১২০ জন শিক্ষককে রিসোর্স পারসনদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘এখন আমাদের লক্ষ্য হবে কিভাবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়। কলেজ এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেন্সমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে আট হাজার শিক্ষককে ট্রেনিং দেওয়া হবে। কিছু শিক্ষককে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হবে। তাঁরা হবেন মাস্টার ট্রেনার।’

 

ক্রীড়ায় সাফল্য: অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের দল সম্প্রতি আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে দারুণ সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ থেকে ২২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় চারটি ইভেন্টেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রী দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ২৬ থেকে ৩০ নভেম্বর বুয়েটে অনুষ্ঠিত হকি ও লন টেনিস প্রতিযোগিতায় হকি ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন ও টেনিস ইভেন্টে বুয়েটের সঙ্গে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়। ৬ থেকে ৮ ডিসেম্বর সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় ছাত্রীরা চ্যাম্পিয়ন ও ছাত্ররা তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। ১৮-২০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তবিশ্ববিদ্যালয় দাবা প্রতিযোগিতায় হয় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।

 

 

কলেজ র‌্যাংকিং: পরীক্ষার ফল, শিক্ষা কার্যক্রম, অবকাঠামো, শিক্ষার পরিবেশসহ বিভিন্ন কেপিআইয়ের (কি পারফরম্যান্স ইনডিকেটর) ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে কলেজ র‌্যাংকিং করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি অঞ্চল থেকে ১০টি করে শ্রেষ্ঠ কলেজ নির্বাচন করে পুরস্কৃত করা হবে। এর ফলে কলেজগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা হবে, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সূত্র-কালের কন্ঠ।#

পছন্দের আরো পোস্ট