স্মৃতির পাতায় পাহাড় আর পাথর

IMG_20160321_184241নগ্ন দেহে মগ্ন মোরা, প্রাণের উচ্ছ্বাসে । প্রাণের উচ্ছ্বাসে সবাই আমরা ছুটে চলি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবলোকনে । কিন্তু সেমিষ্টার সিস্টেমে সময় বের করা বড়ই দুষ্কর ।এই ব্যস্ততার মাঝেই যদি হঠাৎ করে একটা ঘুরাঘুরির ব্যাবস্থা হয়ে যায়, তাহলে মন্দ হয় না । ক্লাস টেস্ট, প্রেজেন্ট্রেশন, অ্যাসাইনমেন্ট এর প্রেসারে সবাই যেন ক্লান্ত হয়ে উঠেছে ।এই ক্লান্তির অবসাদ কে ধুয়ে ফেলার জন্য বার আউলিয়ার দেশ যেন ডাকছিল আমাদের ।আর সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল বশেমুরবিপ্রবি’র লোক প্রশাসন পরিবারের শিক্ষার্থীরা এই স্টাডি ট্যুরের আয়োজন করে।

 

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের লোক প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী “তৌফিক রহমান” তাদের এই ট্যুরের কাহিনী বর্ণনা করছিল এভাবেই । দিনটি ছিল ১৩ মার্চ, রবিবার । পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী অমরা সবাই ফ্যাকাল্টির সামনে উপস্থিত হলাম । দুপুর ২ টায় বাস ছাড়ে কথা  । দুটো গাড়িতে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন পরিবারের প্রায় ৮৫ জন নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বাস ছাড়ল সকলের বহুল কাঙ্খিত সিলেটের উদ্দেশ্যে ।

 

১৪ মার্চ সকাল সাড়ে সাতটা, তালতলা, সিলেট । দীর্ঘ প্রায় পনের ঘন্টার নির্ঘুম ভ্রমন শেষে বার আউলিয়ার দেশ পূন্যভূমি সিলেটে পৌছালাম । নাচ, গান আর হইহুল্লোড়ে একবিন্দুও ঘুমানোর উপায় নেই । সিলেটের রাস্তায় নেমে মনে হল, এক একজন যেন আট দশটি করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে । আর যাত্রাপথে জানালাগুলো দিয়ে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশ্রী রকমের বাড়াবাড়ি দেখা যায়, সেটার স্বাক্ষী কেবল যাত্রীগুলোর নিশাচর বিষ্মিত চোখ । বেশীরভাগ সদস্যই তখনো বাসের সিটে গা এলিয়ে বসে আছে, গাড়ি থেমেছে রাস্তার এক কোণে, একটি ছোট্ট সেলুনের ধারে ।

 

ভ্রমণ কমিটির কয়েকজন হোটেল এবং সকালের খাবারের বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত তখন । আমরা কয়েকজন কেবল এদিক ওদিক বেপরোয়া ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছি । বোঝার চেষ্টা করছি এই নতুন রাজ্য । প্রথমেই গেলাম রাস্তার অন্যপাশের একটি চা এর দোকানে । দোকানী একটি দশ-বারো বছর বয়েসী কিশোর । বড় অদ্ভুত তার ভাষা! বোঝা খুব মুশকিল । ক্রিয়া, সর্বনাম,অব্যয় সব খিচুড়ী পাকিয়ে সিলেটি ঢং এ যা সে বলল, তার মর্মার্থ উদ্ধার করা বেশ কঠিন । যতটুকু বোঝা গেল তা হল তার নাম রফিক । সে খুব ভোরে চা বিক্রি শুরু করে । রং চা পাঁচ টাকা,দুধ চা ….’ এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আজাদ স্যারের একটা কথা বিশেষ স্মরণীয় – “বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে ” সে লেখাপড়া করে কী না, এমন প্রশ্নের উত্তরে এই আহত ভাষার বাসিন্দা বেশ বিরক্ত হয়ে এমনভাবে চোখ কটমট করে তাকালো, যার অর্থ সম্ভবত এইরকম, “ওই মিয়া, চা খাওয়া হইছে না? হইলে ভাগো । এত প্যাচাল পাড়ো ক্যান?

 

“হোটেলে মিনিট চল্লিশের মত রেস্ট নিয়ে আমরা রওনা দিলাম হযরত শাহপরাণের মাজারের দিকে । এই ক্ষনে সেরে নেয়া হল নাস্তা । আমার পূর্ব ধারণা ছিলো শাহজালাল আর শাহপরাণ হয়তো ‘ভাই-টাই’ হয়ে থাকবেন এবং তাদের মাজার থাকবে পাশাপাশি । এখানে এসে বুঝলাম তা নয়, আর সম্পর্কটাও মামা ভাগ্নে! ছোট্ট একটা রাস্তার আশেপাশে অসংখ্য দোকান । সেখানে তসবি, টুপি ছাড়াও রয়েছে হরেক রকমের খাবার এবং মহিলাদের অঙ্গসজ্জার নানা উপকরণ ।

 

মাজার প্রাঙ্গণে পৌছতেই দেখি অনেকগুলো লোক লাল, হলুদ সুতা, নীল আংটি ইত্যাদি নিয়ে ছুটে আসছে আর নতুন আসা দর্শনার্থীদের অনেকটা জোরপূর্বক পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা । আর সেগুলোর বিক্রিও হচ্ছে বেশ ভাল । শাহপরাণ এর মাজারটা বেশ সুন্দর বলতে হয় । মাজার টিলায় উঠা নামার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ হয়ে সিড়ি আছে; যা প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট উচু দেখায় । আমরা সেই সিড়ি বেয়ে শাহপরাণের সমাধীতে গিয়ে পৌছলাম । সমাধীটি নির্মিত একটি গাছের নিচে!!! সমাধীকে ঘিরে প্রার্থনারত সব মানুষকে দেখা গেল । কেউ মন বিষন্ন করে মোনাজাত ধরে আছে, আবার কেউ কাঁদছে । আমাদের কয়েকজন দেখলাম আইন অমান্য করে গোপনে ছবি উঠাচ্ছে । শাহপরাণের মাজার থেকে বেরিয়ে আমরা রওনা দিলাম জাফলং এর দিকে । জাফলংকে কি সৌন্দর্যের দেবী বলা যায়? আমার ধারণা, তাতেও জাফলংকেই অসম্মান করা হবে, দেবীকে নয়! ছোট্ট আকাবাকা রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে জাফলং এর দিকে আর জানালা দিয়ে চোখে পড়ছে দূরের আকাশের সাথে ছুই ছুই খেলা করছে ভারতীয় পাহাড়, যেন প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য! পাহাড়ের উপরে মাঝেমাঝে দেখা মেলে ছোট খাটো দু একটি বাড়ির । আমার মনে হল, জাফলং এ যাওয়ার পথে নদী ঘেষা এই পাহাড়গুলো কি কখনো স্বপ্নে দেখেছিলাম?

 

মনে পড়ল কবিগুরুর কথা, যিনি সিলেটের নাম দিয়েছিলেন ‘শ্রীভূমি সিলেট’। পর্যটন নগরী হিসেবে কেন সিলেট এত পরিচিত তার প্রমাণ পাচ্ছি মুগ্ধ চোখে । জানালা দিয়ে এক একটি বিশাল পাহাড় দেখা যায়, আমার সফরসঙ্গীরা কেবলই বিস্মিত কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে, সেই চিৎকার শুনে দূরের ঐ পাহাড় যেন তার বুকে আশ্রয় দেয়া অসংখ্য গাছের পাতা একটি দুটি করে কেবল নাড়িয়ে দেয়, ওদের আকাশ ছোয়ার প্রতিজ্ঞা আরও দৃঢ় হয়ে জ্বলজ্বল করে ওঠে । প্রকৃতি কণ্যার এই অপরূপ সৌন্দর্যে প্রেমে না পড়াটা যেন অপরাধ!!! সেই অপরাধে আমি দন্ডপ্রাপ্ত হতে পারিনি ।

 

জাফলং এর পিকনিক স্পটে যখন আমাদের গাড়ি দুটো পৌছাল তখন দুপুর । পেটে একরাশ বায়বীয় মুগ্ধতাই কেবল, দানাপানি নেই বিন্দুমাত্র । কাছাকাছি একটা হোটেলে খাওয়ার বন্দোবস্ত হল । খাওয়া শেষ হলে বসবার অবসর যেন নেই । মনে হয় -জাফলং যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আমাকে ডাকছে, তার সেই ডাক যেন আজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এখন । এখন তাকে একটু ছুয়ে দেখবার সময় । সুদৃশ্য পাহাড় চূড়া, স্বচ্ছ জলরাশি আর নানান রং এর নুড়ি পাথরের এক মিলনমেলার নাম যেন জাফলং । খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রকৃতিকণ্যা হিসেবে সারাদেশে বেশ পরিচিত । পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলরাশির স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তুপ জাফলং কে করেছে সৌন্দর্যের জননী । মুগ্ধতাটা যে এমনই, বারবার মনে হয়, সুন্দরেরও একটা সীমা থাকা উচিৎ ।

 

কিন্তু জাফলং যেন সৌন্দর্যের সীমার সব ধারা উপধারা ভেঙ্গে দিব্যি মুগ্ধতার স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে পর্যটকদের চোখে চোখে । হঠাৎ আমাদের মধ্যে কয়েকজন পিয়াইন নদীর জলরাশিতে নেমে পড়ল । শুরু হল একে ওকে ভেজানোর চেষ্টা, পানি ছোড়াছুড়ি!!! মনে হল যেন, ছোট্ট পুকুরের কিছু মাছ হঠাৎ কোন মহাসমুদ্রের সন্ধান পেয়েছে!!! আমার পরনে তখন ভারতীয় পাঞ্জাবি এবং পাজামা । সফরসঙ্গীদের মধ্যে থেকে একজন একটা টি – শার্ট দিয়ে গেল । সেই লালরঙ্গা ঝোলা টি – শার্ট পরেই ঝাপ দিলাম পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলরাশিতে । একটা হলুদ ভলিবল আনা হয়েছিলো, সেটা দিয়ে ছোটবেলার সেই ‘ব্যোম ব্লাস্টিং ‘ খেলা শুরু হল । সাথে বন্ধু, জুনিয়র আর সিনিয়রেরা । পানির মধ্যে এ প্রান্তে আমরা উন্মাদের মত গড়াগড়ি খাচ্ছি আর ও প্রান্তে ভারতীয়রা ঘুরে বেড়াচ্ছে; এ যেন এক অভাবনীয় দৃশ্য!

 

লাফালাফি আর ঝাপাঝাপির পর সবাই যখন সোজা পথে পাহাড়ের নিচের রাস্তা দিয়ে ফেরায় ব্যস্ত, আমি তখন দুই-তিনজন কে নিয়ে শুরু করলাম পাশের ঈষৎ লাল বর্ণের পাহাড়ে ওঠার অভিযান । আমরা চার টগবগে তরুণ তাই চলেছি পাহাড়ের চূড়ায় নিজেদের পদচিহ্ন রেখে আসতে । অবশেষে চূড়ায় পৌছে ভারতীয় সব পাহাড়কে পেছনে রেখে তোলা হল ছবি । তারপর পাহাড়ের অন্য প্রান্ত দিয়ে যাত্রা শুরু, যদিও কেউই আমরা জানিনা এই পথ আমাদেরকে আদৌ পিকনিক স্পটে পৌঁছে দেবে কি না । যদিও স্যার বলেছেন আর দশ পনের মিনিটের মধ্যেই গাড়ি ছাড়বে, কিন্তু এসব কথা ভুলে আমরা প্রত্যেকে যেন তখন এক একজন ভাস্কো -ডা – গামা! যাত্রা পথে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যখন লোকালয়ে পৌছলাম, প্রায় ছয়টির মত পাথর ভাঙ্গার ছোট ছোট কারখানা চোখে পড়ল ।

 

স্থানীয় কয়েকটি অদ্ভূত গড়নে বাড়ি দৃষ্টি এড়াল না । রাস্তা যখন শেষ হল তখন বুঝলাম, মূল পর্যটন এলাকা থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছি আমরা । সবার মধ্যেই উৎকন্ঠা তখন, এতক্ষণে গাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেল না তো? না গাড়িদুটো এখনও যায়নি, সেইখানেই স্থির দাড়িয়ে আছে । তখনো ভেজা কাপড় পাল্টানো হয়নি!!! জাফলং থেকে জ্বর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি কী না, এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে খুজতে বাসে গিয়ে উঠলাম । বাস ছাড়ল সোজা হোটেলের দিকে ।

 

Post MIddle

পরদিন সকাল সাতটা । গতকাল সারাদিন একটু অবসর পাইনি । তাই রাতে হোটেলের বিছানায় গা এলিয়ে পড়া মাত্রই যেন হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে । ঘুমে যখন ছেদ পড়ল তখন ভোর । আজ তিনটি স্পটে যেতে হবে । সকালের নাস্তা সেরে নেয়া হল স্থানীয় একটি হোটেলে । শাহজালালের মাজারে যখন পৌছাই, তখন ঝকঝকে রোদ গ্রাস করেছে পুরো শহর । মূল মাজার প্রাঙ্গনে পৌছেই সর্বপ্রথম চোখে পড়ল কয়েক ঝাক কবুতর । এই কবুতর আবার জালালী কবুতর নামে বিশেষভাবে খ্যাত । এই কবুতর গুলোকে ঘিরে খুব অদ্ভুত একটি কাহিনী প্রচলিত আছে, যার বর্ননা করার সময় এসেছে ।

 

কথিত আছে, শাহজালাল সিলেট আগমন কালে দিল্লী থেকে আসার সময় নিজামুদ্দীন আউলিয়া প্রদও একজোড়া কবুতর নিয়ে আসেন । পরবর্তীকালে এই কবুতর বংশবৃদ্ধি করে সংখ্যায় বাড়ে এবং জালালী কবুতর হিসেবে পরিচিতি পায় । ধর্মীয় অনুভূতির কারনে এই কবুতর কেউ শিকার কিংবা খেত না । শাহপরাণ এ বিষয়টি আমলে না নিয়ে প্রতিদিন গোপনে একটি করে কবুতর খেতেন। এতে কবুতরের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেলে শাহজালাল এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে শাহপরাণের বিষয়টি জানতে পারেন এবং বলাবাহুল্য বেশ রুষ্ট হন । তখন শাহপরাণ গোপণ করে রাখা মৃত কবুতরের পালকগুলো বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আল্লাহর হুকুমে কবুতর হয়ে শাহজালালের কাছে পৌঁছে যাও ” সাথে সাথে পালকগুলো একঝাঁক কবুতর হয়ে শাহজালালের কাছে গিয়ে হাজির হয়,আর শাহজালাল শাহপরাণের এই অলৌকিক ক্ষমতা দেখে সন্তুষ্ট হন । শাহজালালের সমাধীটি বেশ সুন্দর । সেখানে প্রার্থণারত মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে কবেকার মৃত এই সুফি সাধকের দিকে, যিনি ঘুমিয়ে আছেন মহাকালের সব সাক্ষ্য বুকে নিয়ে ।

 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ি দুইটি দ্বিতীয়বারের মত থামলো । বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ ঘুরে এলাম । শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মিজানুর রহমান স্যারের সাথে স্বল্পসময়ের জন্য আলাপ হল ওখানকার একজন শিক্ষকের সাথে । বেশ আন্তরিক ভাবেই তিনি আমাদেরকে স্বাগত জানালেন । সময় স্বল্পতার কারনে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা সম্ভব হল না । “চেতনা ৭১” এর সামনে সবাই একটি গ্রুপ ছবি তুলেই জলদি ফিরতে হল গাড়িতে ।

 

এবার যেতে হবে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক । ইকোপার্কে এসে আমাদের বেশ হতাশই হতে হল । ভেবেছিলাম জাফলং এর মত হাত পা ছুড়ে পানিতে গড়াগড়ি খাওয়া যাবে, কিন্তু কপাল মন্দ । জলপ্রপাতের কাছে পৌছনোর বেশ আগেই বুঝলাম সেগুড়ে কেবল বালিই নয় বরং সিমেন্ট । গ্রীষ্মকাল হওয়ায় পানি অনেকটাই শুকিয়ে গেছে । যতটুকু আছে, তাতে আর যাই হোক, গোসল কিংবা খুনসুটি অন্তত অসম্ভব । কিন্তু জলপ্রপাতের কাছাকাছি এসে বিষন্নতা কিছুটা কমল । এত সুন্দর দৃশ্য ও বাংলাদেশে আছে?

 

প্রায় ১৬২ ফুট উচু থেকে একটি পাহাড়ের গা ঘেষে পানির কুন্ডলী আসছে নিচের ছোট্ট খালের মত জায়গাটিতে, ভাবা যায়? মাধবছড়ার এই পানি নাকি আবার প্রবাহিত হতে হতে সোজা গিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরে । পাহাড়ের পাদদেশে থেকে প্রবল ধারায় পড়ছে পানি । এ কি পাহাড়ের কান্না? নাকি ভ্রমনবিলাষীদের আকর্ষণ করার জন্য প্রকৃতির সৃষ্ট কোন ইন্দ্রজাল? আমার সফরসঙ্গীরা তখন ভীষণ ব্যস্ত প্রকৃতির এই রাজকন্যার পাশে নিজেকে ফ্রেমবন্দী করে রাখতে । মাধবকুন্ডে এসে যান্ত্রিক এই নাগরিক মন যেন মুঠোভর্তি শান্তির আশ্রয় খুজে পেয়েছিলো- আরও ভাল হত, এই অদ্ভুত সুন্দর জলপ্রপাতের পানিতে নিজেকে ভেজাতে পারলে । কিন্তু হাতের লেখায় তা হয়তো লেখা নেই । তাই ফিরে আসতে হল শুকনো শরীরেই । স্থানীয় একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর সবাই যখন গাড়িতে গিয়ে উঠল, ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়েছে ।

 

১৬ মার্চ বুধবার সকাল দশটা, শ্রীমঙ্গল!!! ফেরার দিন । তবে এই সৌন্দর্যের রাজধানীকে বিদায় দেয়ার পূর্বে আমরা দেখবো আরও দুইটি স্থান : মাধবপুর লেক ও রাবারবাগান । গতকাল রাতে আমরা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এসে পৌছেছি । শ্রীমঙ্গলকে বলা হয় চা এর রাজধানী । ছোট্ট শহরটি যেন ছোটখাটো একটি চা এর রাজ্য । দেশের  ১৬৩ টি চা বাগানের প্রায় ৯১ টি চা বাগান এই জেলায় অবস্থিত । এখানকার সাত রঙয়ের চা এর বেশ সুনাম । ‘পানশি’ নামে স্থানীয় একটি হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে আমরা রওনা হলাম মাধবপুরের লেকের দিকে । এই স্থানটির বর্ননা যদি দিতে হয়, তবে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী কিলিওপেট্রাকে উপমা হিসেবে আনতে হবে ।

 

যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়, তার মধ্যে বয়ে যাচ্ছে পদ্মফোটা একটি লেক!!! পাহাড়ের গায়ে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে বিস্তীর্ণ চা গাছ । চা গাছ ছাড়াও অন্যান্য অসংখ্য গাছও চোখে পড়ার মতো । তাদের এক একটির উচ্চতা দেখলে মনে হয় পাহাড়ের সাথে বাজি ধরেছে নিজেকে আরও বড় করবার । নাম না জানা কিছু পাহাড়ি ফুল চোখে পড়ে, যেগুলো দেখতে বেশ সুন্দর….।

 

একটি বেশ উচু পাহাড়ের চূড়ায় এসে কয়েকজন চা বাগান কর্মীর সাথে আলাপ হল । তাদের ভাষায় কিছুটা বঙ্গদেশীয় আঞ্চলিক, কিছুটা ভারতীয় টান বিদ্যমান । সুধান দাস নামে একজন কর্মীর কাছে জানতে পাই, এই পাহাড়টির নাম চান্দু পাহাড় । সুধান দাস, কৃষ্ণ, নাম না জানা আরও অনেকের মুখে উঠে আসে তাদের জীবনযাত্রার গল্প । মাত্র পঁচাশি টাকার জন্য তারা সারাদিন রোদ, বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে পাহাড়ে কাজ করে চলেছেন দিনের পর দিন । জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের এই কাজ চলে এসেছে বংশানুক্রমিক ভাবে । সুধান দাসের মত এই একই কাজ করতেন তার বাবা, তার বাবা,তার বাবা ..।

 

চান্দু পাহাড়ের চূড়ায় যখন চলে এসেছি, তখনই শুরুতে হল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । শ্রীমঙ্গলে আসলাম আর বৃষ্টিতে ভিজবনা তা কি হয়? শ্রীমঙ্গল যেন আমাদেরকে আরো উষ্ণ ভাবে বরন করার জন্য আয়োজন করল এই টিপটিপনী বৃষ্টির । চা বাগান আর পাহাড়ের অপরুপ সৌন্দর্যে কেবলই মুগ্ধ হই, আর মনে পড়ে ফ্রিল্যান্স লেখক এন্টনির কথা, যিনি শ্রীমঙ্গলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এর নাম দিয়েছিলেন ‘এক খন্ড স্বর্গ’ । চা বাগান থেকে বেরোতে মন চাইছিল না মোটেই, কিন্তু, ফিরে তো যেতে হবেই ।

 

দুপুরের খাবারটা বেশ জমল পানশি হোটেলে । খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ততক্ষণে আমাদের কয়েকজনের বেশ কুখ্যাতি ছড়িয়ে গেছে দুটো বাসেই । এই ব্যাপারটাও উপভোগ করছি বেশ! রাবার বাগান দর্শনের মধ্যদিয়ে আমাদের ভ্রমনপর্বের ইতি ঘটল । এখানে আমরা মাত্র মিনিট পঁচিশের মত দাঁড়িয়েছিলাম । রাবারের বির্স্তীর্ণ বাগান, সেও এক দেখার জায়গা বটে! অন্যান্য জায়গার মত, রাবার বাগানে এসেও ছবি তোলার ধূম পড়ে গেল ।

 

অবশেষে, আমাদের গাড়ি দুইটি চির পরিচিত নগরী গোপালগঞ্জের দিকে যাত্রা শুরু । একটু যেন বিষন্নতা ছুয়ে গেল মনের কোথাও। এই ক’দিনেই যে সিলেটের প্রেমে পড়ে গেছি, তা স্বীকার করতে সংকোচ বোধ করছি না!!! মুগ্ধতা যেন কাটছেই না । চোখে এখনও বিষ্ময় ভর করে আছে। মনে হয়, শিকলপরা দুপায়ের এ দেহ ফেলে রেখে সিলেটের পাহাড়ি জঙ্গলে পাখি হয়ে থেকে যাই আজীবন । সিলেট যেন তার অতিমানবিক ইন্দ্রজাল দিয়ে ডাকছে আমাকে, সেই ডাক উপেক্ষা করে ফিরে আসা বড্ড কঠিন ।

 

 

পছন্দের আরো পোস্ট