জীবন যুদ্ধে জয়ী চবির ফারহানা ইয়াসমিন

দিনভর ক্লাসে ডুবে থাকা। এরপর বিকেল থেকে রাত ১০টা অব্দি টিউশনির তাগাদায় এ বাড়ি ও বাড়ি। তারপর গভীর রাত পর্যন্ত নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ। সঙ্গে পরিবার টেনে নেওয়া-সেখানেও তিনি।এসব কিছুর একটাই প্যাকেজ-‘ফারহানা ইয়াসমিন’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।

 

সারাদিন ক্লাস করার পর অন্য বন্ধুরা যখন একটু জিরিয়ে নেওয়ার আয়েশে থাকতেন- তখন তিনি দেদারসে টিউশনি করছেন। ‍বন্ধুরা যখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তিনি মাঠে, একটি ব্যাংকের সেলস এক্সিকিউটিভ।এতকিছুর পরও ছন্দপতন হয়নি ফলাফলে। নিছক মনের জোরেই স্নাতকে ৩ দশমিক ৭৯ পেয়ে হয়েছিলেন প্রথম।

 

ফারহানার সে কৃতীত্ব হয়েছে পুরস্কৃত। চলতি বছর প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পেয়েছেন তিনি। ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে নিয়েছেন পদক আর সনদ। প্রতিবন্ধকতার সব শেকল ভেঙে যুদ্ধজয়ী সোনার মেয়ে।ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বাড়ি ফেনী জেলায়। তবে বাবার চাকরির সুবাদে বড় হওয়া চট্টগ্রাম শহরেই।

 

গত শতাব্দীর শেষের কথা। বাবা জয়নাল আবেদিন চিটাগাং স্টিল মিলের চাকরিজীবী। মোটামুটি ভালোই চলছিল ফারহানাদের সংসার। কিন্তু আচমকা ১৯৯৯ সালে সরকার বন্ধ ঘোষণা করে স্টিল মিলটি।এরপর জয়নাল আবেদিন এই ব্যবসা সেই ব্যবসায় মার খেয়ে সবশেষে একটি দোকান দিয়ে স্থায়ী হন। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। ২০১০ সালের দিকে সেই দোকানটিও একটি ডেভোলপার কোম্পানির কব্জায় পড়ে গেল। পরিবার আর চলছে না। জয়নাল আবেদিন ব্যবসা হারিয়ে মোটামুটি স্বর্বসান্ত। বন্ধের পথে সন্তানদের পড়ালেখাও।

 

এমন সময় পথ দেখালেন বড় মেয়ে ফারহানা।ওদিকে চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা আসন্ন। কিন্তু শুধু পড়ালেখা নিয়ে পড়ে থাকার সময় কই ফারহানার? তাকে যে টানতে হবে পরিবার।তাই সিটি ব্যাংকে যোগ দিলেন সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে। একদিকে নিজের পড়াশোনা, অন্যদিকে চাকরি। এভাবে পরীক্ষা দিয়েই হন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম।

 

কিন্তু পড়ালেখা আর চাকরি একসঙ্গে টানতে পারছিলেন না ফারহানা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের রেখে দেওয়ার জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার আগে ইস্তাফা দিলেন চাকরি থেকে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে ছাড়তে চাইবেনও বা কেনো? ছোট্ট চাকরি জীবনে ফারহানা যে হন টপ সেলস এক্সিকিউটিভ।

 

Post MIddle

তবে মেয়ের পুরো কীর্তি দেখে যেতে পারেননি বাবা জয়নাল আবেদিন। ২০১৩ সাল থেকেই না দেখা ভুবনের বাসিন্দা তিনি।ফারহানা ইয়ামিন বলেন, ‘জীবনে একের পর এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু থেমে যাইনি। রাত ১০টা পর্যন্ত টিউশনি করেছি, আবার নিয়মিত ক্লাসও করেছি। যা করেছি মনোযোগ দিয়েই করেছি। আমি আমার স্যার আর বন্ধুদের নিকট অনেক কৃতজ্ঞ। তাদের ভালোবাসা আর সহযোগিতা এতদূর নিয়ে এসেছে আমায়।’

 

প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বর্ণপদক নেওয়ার সময় কার কথা বেশি করে মনে পড়ছিল- এমন প্রশ্নে ছলছল হয়ে ওঠে ফারহানার চোখ।বলতে থাকেন বাবা থাকলে ভীষণ খুশি হতেন। সবসময় সাহস জুগিয়েছেন আমাকে। বলতেন ‘‘মা তোকে দিয়েই হবে’’। কোথায় হারিয়ে গেল সেই বাবা। কান্নায় চোখ বুজে ওঠে ফারহানার।

 

ছোট দুই বোনের একজন চবি’র বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটে এবং আরেকজন চট্টগ্রাম কলেজে বাংলা বিভাগে পড়ছেন। আর একমাত্র ভাইও চবির ফাইনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে এবার স্নাতকত্তোর পরীক্ষা দিচ্ছেন।আদরের বড় আপুর কাছে কৃতজ্ঞ তারা তিনজন।

 

বড় আপুর প্রতি শ্রদ্ধায় নুইয়ে পড়া রকিবুল হাসানের বক্তব্য, ‘আপু না হলে এতদূর আসা হতো না। আমাদের কাজ ছিল শুধু পড়াশোনা করা। বাকি সব সামলেছেন আপু। বই-খাতা লাগবে-এনে দিলেন আপু, ভর্তি ফি লাগবে-দিয়ে দিলেন আপু। রাতদিন নিজে কষ্ট করে আমাদের এগিয়ে নিচ্ছেন তিনি।’

 

‘ভাই থাকলেও হয়তো এতটা দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বোঝা কাঁধে নিতেন না।’ যোগ করেন রকিবুল হাসান।ফারহানা এখন ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম এ লেকচারার হিসেবে কর্মরত আছেন।

 

সাফল্যের শিখরে ওঠেও সংগ্রাম থামেনি ফারহানার। তার মনে এখন পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি। ইচ্ছে পিএইচডি করবেন, একদিন বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ফিরবেন, আরও ভালো কিছু করবেন।

 

এবং অবশ্যই পরিবারের হাল ধরবেন…..

পছন্দের আরো পোস্ট