কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
কারিগরি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তব অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। এ শিক্ষার মানোন্নয়নে একের পর এক প্রকল্প গৃহীত হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের মাধ্যমে কেবল প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। নির্দিষ্ট মেয়াদের পর প্রকল্প শেষ হচ্ছে আর পড়ে থাকছে শুধু ফাঁকা ভবন। কোনো শিক্ষক-কর্মচারী না থাকায় বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। এতে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় (১৩৬ কোটি টাকা) টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং রিফর্ম নামক একটি প্রকল্প, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় (৪৬০ কোটি টাকা) স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ নামক প্রকল্প এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় (৬৩৫ কোটি টাকা) স্কিল অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট নামক মোট তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে। সম্প্রতি সরকারি অর্থায়নে প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলোর আগে আরও কয়েকটি প্রকল্প শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেছে। ওইসব প্রকল্পের মধ্যে অধিকাংশই সফলভাবে শেষ হয়নি। যেসব প্রকল্পের কাজ চলছে সে প্রকল্পগুলোও সফলভাবে শেষ হবে কিনা তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সরকার ১৯৯৭ সালে গৃহীত ১৮টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্পের কাজ হাতে নিলেও বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষক ও কর্মচারীর চাকরি নেই। এসব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাড়াও ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেও সেসব প্রতিষ্ঠানে ভবন ছাড়া কিছুই নেই।
কারিগরি শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এদেশের কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরাজ করছে বেহাল দশা। তারা বলছেন, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, প্রচার ও পাঠ্যক্রমে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। কারিগরি শিক্ষায় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাস্তবভিত্তিক কোনো সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগে কর্মসংস্থানের সুযোগও অনেক কম। উন্নত বিশ্বে মধ্যম স্তরের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে এ হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ। উপরন্তু এ শিক্ষা ব্যবস্থা অবহেলিত ও উপেক্ষিত বিবেচিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে ৪৯ এবং বেসরকারি ২০০টি। এছাড়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে সরকারি ৬৪ এবং বেসরকারি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট রয়েছে ১ হাজার ৮৩৩টি। ৪৯টি পলিটেকনিকের মধ্যে ১৮টিতে জনবলের পদ রয়েছে ১ হাজার ৯৩২। এর মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ১০ জনই শূন্য। আর ৪৯টিতে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ মোট শিক্ষকের পদ রয়েছে ২ হাজার ৫০৯টি। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিক্ষকের পদ শূন্য। যদিও সম্প্রতি স্কিল অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে মোট শূন্য পদের মধ্যে ৫৩০ জন শিক্ষক শুধু প্রকল্প চলাকালীন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আরও শিক্ষক নিয়োগের জন্য কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকারি ৪৯টি পলিটেকনিকের মধ্যে ২১টিতে নেই কোনো অধ্যক্ষ। উপাধ্যক্ষরা ওই পদের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে রয়েছেন। এছাড়া উপাধ্যক্ষ পদের একধাপ নিচের পদ চিফ ইনস্ট্রাক্টররাও সরকারি পলিটেকনিকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, নতুন প্রজন্মকে বিশ্বমানের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সিলেবাস বিশ্ববাজারের জনবল চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এজন্য দেশের প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, দেশীয় শিল্প কারখানার জনবল চাহিদা নিরূপণ, পলিটেকনিকগুলোতে ডাবল শিফট চালু, টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি জানান, পাঁচ বছরে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার ১ থেকে ৬ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ১৫ বছরের মধ্যে এ হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, শিক্ষক স্বল্পতা কাটিয়ে ওঠার জন্য টেম্পোরারি একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নে যে তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে সেগুলোর মেয়াদ শেষ হলে অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে তা বোঝা যাবে। তিনি বলেন, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এ শিক্ষার এখনও গুণগতমান তেমন বাড়েনি, তবে চেষ্টা চলছে।
কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে মধ্যম স্তরের কারিগরি শিক্ষার মধ্যে রয়েছে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন কৃষি, ডিপ্লোমা ইন মেরিন, ডিপ্লোমা ইন ফিশারিজসহ বিভিন্ন মেয়াদের বৃত্তিমূলক শিক্ষা। দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ৪৯টি সরকারি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৩টি কৃষি প্রশিক্ষক ইনস্টিটিউট, ছয়টি টেঙ্টাইল ইনস্টিটিউট, একটি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, দুটি সার্ভে ইনস্টিটিউট রয়েছে। জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর অধীনে রয়েছে ৩৫টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে। এছাড়া কারিগরি বোর্ডের অধীনে বেসরকারিভাবে ৯৭টি কৃষি ডিপ্লোমা এবং ১২৮টি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে।##
আরএইচ