দেশেই গবাদিপশুর রোগের নির্ভুল পরীক্ষা করা সম্ভব
বাকৃবি থেকে মোঃ আশিকুজ্জামান
ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে কম খরচে ও স্বল্প সময়ে গবাদিপশুর রক্ত পরজীবী দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন রোগের প্রায় শতভাগ নির্ভুল নির্ণয় পদ্ধতির সূচনা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সহিদুজ্জামান ও তার গবেষক দল
সিরাজগঞ্জ ও রংপুরের বিভিন্ন খামার থেকে প্রায় পাঁচ শতাধিক নমুনা পরীক্ষা করার মাধ্যমে এই পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) এর অর্থায়নে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
অধ্যাপক সহিদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে গবাদিপশুতে রক্ত পরজীবী বিশেষ করে বেবিসিয়া, থাইলেরিয়া ও এনাপ্লাজমার প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্য । এসকল জীবাণুর সংক্রমণে সংঘটিত রোগের কারণে গবাদিপশুর ওজন হ্রাস,রক্ত স্বল্পতা ও দুধ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত যায়। এমনকি চিকিৎসা সঠিকভাবে না হলে আক্রান্ত পশুর মৃত্যুও হতে পারে।
অধ্যাপক বলেন, মাঠ পর্যায়ে সাধারণত এসব রোগের লক্ষণ দেখে আক্রান্ত পশুর চিকিৎসা প্রদান করা হয় বলে চিকিৎসা ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আক্রান্ত পশুর রক্তে জীবানুর উপস্থিতি নির্ণয়ে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হয়। তবে এসব পদ্ধতি ব্যবহার করে শতভাগ সঠিক রোগ নির্ণয় সম্ভব হয় না। বিশ্বের অনেক দেশে ডিএনএর মাধ্যমে গবাদিপশুর রোগ নির্ণয় করা হলেও দেশের মাঠ পর্যায়ে এখনো এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় নি।
অধ্যাপক সহিদুজ্জামান আরও বলেন, প্রথমে প্রাণীর রক্ত সংগ্রহ করে ডিএনএ নিষ্কাশন করা হয়। নিষ্কাশিত এই ডিএনএ পিসিআর মেশিনের মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। রক্তপরজীবীর সামান্য পরিমাণ ডিএনএ ওই নমুনায় উপস্থিত থাকলেও এই পরীক্ষায় তা সহজেই শনাক্ত করা যায়। প্রক্রিয়াটি পিসিআর নির্ভর হওয়ায় প্রায় শতভাগ নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যায়।
তিনি আরো জানান, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগে এবং একসাথে অনেকগুলো নমুনা পরীক্ষা করা যায়। প্রতিটি নমুনা পরীক্ষা করতে গড়ে পাঁচশত থেকে সাতশত টাকা খরচ হয়।
মৌলবীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কর্ণ চন্দ্র মল্লিক বলেন,বেবিসিয়া আক্রান্ত পশুর মূত্র কফির মতো রঙের হয়। তবে মূত্র দেখে বেবিসিয়া রোগ নির্ণয় করা গেলেও থাইলেরিয়া ও এনাপ্লাজমা লক্ষ্মণ দেখে নির্নয় করা যায় না।
রংপুর জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. মো. জোবাইদুল কবীর বলেন, বেবিসিয়া, থাইলেরিয়া ও এনাপ্লাজমা এই তিনটি রোগের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে আগে তেমন ছিলো না। বর্তমানে রংপুর অঞ্চলে উচ্চ উৎপাদনশীল গবাদিপশুর জাতগুলোতে রোগগুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরো বলেন, এনাপ্লাজমোসিস আঠালি দ্বারা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে সংক্রমিত হয়। উন্নত বিশ্বে এ রোগ হলে আক্রান্ত প্রাণীটিকে খামার থেকে বাতিল করে দেয়া হয়। আমাদের দেশে এই পদ্ধতির প্রচলন না থাকায় খামারে রোগের সংক্রমণ হার অনেক বেশি।
তিনি আরো বলেন, জিমসা স্টেইনিংয়ের মাধ্যমে
আঞ্চলিক প্রাণীরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারে (এফডিআইএল) এ রোগগুলো নির্ণয় করা হয়। তবে এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দক্ষ জনবল। অনেক সময় থাইলেরিয়া ও এনাপ্লাজমা নির্নয়ে তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যাওয়া। ফলস্বরূপ সঠিক ফলাফলও পাওয়া যায় না।
অধ্যাপক সহিদুজ্জামানের পদ্ধতি সম্পর্কে ড. জোবাইদুল বলেন, ডিএনএ পর্যায়ে গবাদিপশুর রোগ নির্ণয়ের যে পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে এটি মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার করতে পারলে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
অধ্যাপক সহিদুজ্জামান আবারও বলেন,একজন ভেটেরিনারিয়ান হিসেবে দেশের প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন করা আমার পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলাদেশ সরকারের টাকায় আমি এই গবেষণাটি সম্পন্ন করেছি। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় এই প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হলে খামারিরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবেন পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।