আমেরিকার বুকে মণিপুরী নৃত্য

যুক্তরাষ্ট্র এক বিশাল দেশ। এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্মিলনে সারা বছরই সংস্কৃতির চর্চা হয়। যেমন শাস্ত্রীয় নৃত্য, সঙ্গীত, লোকনৃত্য, খেলাধুলা প্রভৃতি। কেবল ক্যানসাস সিটিতেই আফ্রিকান, মধ্যপ্রাচ্য, আরব ইউরোপীয়, দক্ষিণ ও মধ্যএশীয়, পশ্চিম এশীয়, পূর্ব এশীয় অঞ্চলের শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার চর্চা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আজকে ভারতীয় ও বাংলাদেশীয় মণিপুরী-শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা সম্পর্কে আলোচনা করার সুযোগ নিচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যভাগে ক্যানসাস সিটির অবস্থান। এ স্থানকে আমেরিকার প্রাণকেন্দ্র বা হৃদয় বলা হয় (Heart of America)। ব্যালে নৃত্য চর্চা এখানে প্রাধান্য পেলেও পশ্চিম আফ্রিকান, এরিয়াল, ফ্লেমিঙ্গো, পূর্ব ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য, আধুনিক, হিপহপ ও অন্যান্য নৃত্য চর্চা হয় প্রতিষ্ঠানিকভাবে, প্রতিষ্ঠানটির সর্বপরিচিত নাম সিট ইন মোশন (City in motion)। প্রতি বছর এর উদ্যোগে। গত ১৮ বছর যাবত, উন্মুক্ত মঞ্চে নৃত্য পরিবেশিত হয়। গত বছর (২০১৬ সালে) সেপ্টেম্বর মাসে এ মঞ্চে বাংলাদেশের মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্য ও আধুনিক নৃত্য পরিবেশন করেন ওয়ার্দা রিহাব, রাইয়া খান, জুলি স্টিইনবাক, ক্রিস্টিনা আলী ও কেইটি কার্টার। তাদের নৃত্য পরিবেশনে ছিলাম আমি রাফিয়া সুলতানা রাসুও।

রাফিয়া বাংলাদেশের ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের ছাত্রী ও শিক্ষক মণিপুরী নৃত্যশিল্পী। বর্তমানে ক্যানসাসের বাসিন্দা, তিনি ‘সিটি ইন মোশন’ ইনস্টিটিউটের মণিপুরী নৃত্যের শিক্ষক ও শিল্পী বহু বিদেশী শিল্পী এখানে বিগত ১৫ বছর ধরে তার কাছে মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্য শিক্ষার সুযোগ পায় ও আনন্দ বিতরণ করে। মণিপুরী নৃত্যের উৎস ভারতের পূর্বাঞ্চলে ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রান্তে, বার্মার সীমান্ত লাগোয়া। এশিয়ার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বেড়ে ওঠা শাস্ত্রীয় নৃত্য শিল্পগুলোর মাঝে মণিপুরী নৃত্য প্রধান একটি শাস্ত্রীয় নৃত্য শিল্প। প্রাচীন এ নৃত্যশিল্প বাংলার মাটিতেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় নতুন প্রাণ পেয়েছে। ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে এ নৃত্য পরিবেশনার নিয়ম, কায়দাকানুন বা কম্পোজিশন দেখে মুগ্ধ হন। বর্তমানে মণিপুরের কিছু অংশ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের অন্তর্গত। মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্য শিল্পের বেশ কয়েকজন গুরু তাদের নৃত্য পরিবেশনায় মূল মণিপুর নৃত্যের নৃত্যতাল বা করিওগ্রাফী ব্যবহার করে রবীঠাকুরের নৃত্যনাট্য পরিবেশনায় প্রভাব রাখে। শতবর্ষ পূর্বের এ প্রভাব আজ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতায় গুরু কলাবতী দেবীর পরিচালনায় পঠিত হয়। এখানে উল্লেখ্য, মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্যের কিংবদন্তী প্রতিষ্ঠিত গুরু বিপিন সিং গত সত্তর দশকে কলকাতার শাস্ত্রী মণিপুরী নৃত্যচর্চা কেন্দ্র। মণিপুরী নৃত্যনালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কলাবতী দেবী তার গুণবতী স্ত্রী ও এ নৃত্যচর্চার যথাযথ উত্তরসূরি।

Post MIddle

মণিপুরী নৃত্য-আমেরিকার উন্মুক্ত মঞ্চের ওপর ভারত-বাংলাদেশী ঐতিহ্যবাহী রঙিন প্রাকৃতিক রঙের পোশাকে সজ্জিত নৃত্যকুশলীদের দ্বারা বর্ণচ্ছটা ছড়ায়, রঙিন আবহ তৈরি করে স্টেজে, বর্ণিল পোশাকের ওপর সোনালী সূক্ষ্ম কারুকাজ ন ত্যের তালকে মোহনীয় করে। সর্বোপরি নগ্নপায়ে তাল সৃষ্টির মাহাত্ম্য ও নৃত্য, নূপুর ধ্বনি, মৃদঙ্গের বাজনা বা ধ্বনি দর্শকদের অবাক করে। স্বর্ণালঙ্কারের ঝলমলিন রং প্রাচীন মণিপুরী রাজ্যের এক অপূর্ব ঐতিহ্য তুলে ধরে, এই আধুনিক আমেরিকার বুকে। বর্তমান বাংলাদেশের মণিপুরী নৃত্যগুরু কলাবতী দেবী, শর্মিলা ব্যানার্জি, তামান্না রহমান, শান্তিবালা সিনহার ছাত্রী, রাফিয়া সুলতানা রাসু ও ওয়ার্দা বিহারের দীর্ঘদিনের সাধনা ও শিক্ষকতা এক অসাধারণ পরিবেশনা উপস্থাপন করে। এরা সবাই বাংলাদেশের বিখ্যাত সংস্কৃতি কেন্দ্র ‘ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন’ এর ছাত্রী ও শিক্ষক। অপূর্ব এ পরিবেশনায়-বাল্য কৃষ্ণ নর্তন, ননীচুরি, মন্দিরা, বাকলাই ও লঙুল ছিল প্রধান। অনুষ্ঠানের সবাই এ সবের কলাকুশল তা দেখে মুগ্ধ ও মোহিত হয়। ক্যানসাসে আয়োজনরা এ শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রসারে ব্যাপারে আগ্রহী হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, বাকলাই নৃত্য টেকনিকটি খুবই জটিল। সম্পূর্ণ হাঁটুর ওপর নির্ভর করে এটা করতে হয়। ফলে বাকলাই ফরমটি দেখাবার সময় মঞ্চে উপবিষ্ট সকল দর্শক করতালি দিয়ে উন্মুক্ত মঞ্চ মুখরিত করে। এ ফরমকে অনবদ্য মনে করা হয়। এর আমেজ ছিল ভিন্ন রকমের। উন্মুক্ত মঞ্চে পরিবেশিত সেদিনের সকল নৃত্যের মাঝে মণিপুরী নৃত্যের নাম সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

এখানে বলে রাখা ভাল যে, দর্শকদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য অনুষ্ঠানের শুরুতে মণিপুরী নৃত্যের পরিচিতি মূল রীতিনীতি ও দর্শন তুলে ধরার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। দর্শকরা নৃত্য পরিবেশনে আগে বক্তব্য শোনে আপ্লুত হয়। তারা নৃত্যের তালে তালে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। আনন্দমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

পছন্দের আরো পোস্ট