তুরস্কে ঈদুল আজহার অন্যরকম অনুভূতি

অাপনজন থেকে দূরত্ব যত বাড়ে, ভালবাসার টান ও যেন ততই বাড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ৫ বছর অবস্থানকালীন বেশ কয়েকবার ঈদ ঢাকাতে করার সিদ্ধান্ত নিয়েও কখনো বাস্তব হয়ে ওঠেনি। কারণটা সবার জানা,সোজা -সাপ্টা ভাষায় রক্তের টান; যার কাছে হার মেনে যায় সাজানো অনেক পরিকল্পনা। অার এ জন্যই এরিস্টটল মানুষকে বলেছেন সামাজিক জীব। যাহোক সময়ের প্রয়োজনে ঢাকা থেকে ৫,৪১৩ কিলোমিটার দূরত্বের দেশ তুরস্কে বর্তমান অবস্থান অামার। দূরত্ব এবার সত্যি সত্যি নাড়ির টানকে হারিয়ে দিল। এরিস্টটলের সামাজিক জীব কি তাহলে মিথ্যা প্রমাণিত হল! ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তবতা। দ্বিতীয় বারের মত তুরস্কে কোরবানির ঈদ করলাম এবার। বরাবরের মত বাংলাদেশের একদিন অাগে তুরস্কে ঈদ উদযাপিত হয়ে থাকে। সে মোতাবেক (সোমবার) অাংকারাতে ঈদ- উল-আযহার নামাজ আদায় করলাম। নতুন সমাজ,নতুন পরিবেশ,নতুন ঈদ কিন্তু ভিন্ন স্বাদ। এখানে ঈদের নামায খুব ভোরে হয় সাধারণত।

Post MIddle

এজন্য ফজরের সময়ই একবারে ঈদের নামাযের প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছিলাম। ফজরের নামাজের ঠিক ১ ঘণ্টা পর ঈদের নামায শুরু হল। নামায শেষে মুসলমানদের রীতি মত কোলাকুলি। তুরস্কের প্রথা অনুযায়ী স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নামায শেষে সকলকে চকলেট দিয়ে থাকে হাদিয়া স্বরূপ। বাংলাদেশের ন্যায় মুরুব্বীরা খুচরা টাকা(ঈদ বোনাস) দিয়ে থাকে শিশুদেরকে। তুরস্কের মানুষ মুসলমান হওয়ায় কিছুটা বাড়তি সুবিধা। এরা মানুষকে মন দিয়ে ভালবাসে বলেই মনে হয়। মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়ানোর ব্যাপারে এরা জাতিগত ভাবে সিদ্ধহস্ত। ব্যতিক্রম হয়নি বাঙালীদের ক্ষেত্রেও। আশপাশের সব প্রতিবেশীর দাওয়াত কবুল করাটাও যেন কিছুটা কষ্টের ছিল।কেউই ছাড়তে চায়না যে।

কোরবানির রীতি এখানে অনেকটাই ভিন্ন। সরকারী কিছু নির্ধারিত স্থানে তুরস্কে কোরবানি সম্পন্ন হয়। অার এজন্য নির্দিষ্ট সময়ে কোরবানির পূর্বে প্রত্যেকে তাদের চাহিদা মাফিক কোরবানি বাবদ টাকা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পরিশোধ করে থাকে।।ফলে কোরবানি দাতাকে বাড়তি ঝামেলা পোহানো লাগেনা,কারণ নির্দিষ্ট সময়ে সে তার কোরবানীর গোশত হাতে পেয়ে থাকে। চামড়া পৃথক করা, গোশত কর্তন সব কিছু সিটি কর্পোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারি দ্বারা নির্দিষ্ট স্থানে সম্পন্ন হওয়ায় জনসম্মুখে কিংবা রাস্তাঘাটে কোথাও পশু কিংবা রক্ত দেখা মেলেনা।

অানকারারার অদূরে সিনজান নামক স্থানে এবারের ঈদে বের হয়েছিলাম সরেজমিনে কোরবানি দেখার জন্য।সেখানে সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় যেমন কোরবানি করতে দেখেছি তেমনি একটা বড় সংখ্যাও দেখেছি যারা সপরিবারে এসে নিজ হাতে কোরবানি করে নিজেরাই মাংস কর্তন করছিল যা তুরস্কের সামাজিক বৈচিত্র্যের পরিচয় বহন করে। কেউ মাংস কর্তন করছে কেউবা পাশেই গরু বা ছাগলের কলিজা রান্না করছে।বাবা-মা,ভাই-বোন একত্রে এভাবে কাজ করে তারা যে খুবই অানন্দিত তা বুঝলাম তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে।সব মিলিয়ে অানন্দঘন এক পরিবেশ যা কোরবানির এসব নির্ধারিত স্থানে না অাসলে ধারণা করাটাও সম্ভব হতনা।

ঈদের দিন এখানে পারিবারিকভাবে সবাই ঘুরতে বের হয় সাধারণত। প্রেমিক- প্রেমিকারা যথারীতি অন্যান্য দেশের ন্যায়। তবে পার্কগুলোতে কেউ কাউকে উত্যক্ত করার তো প্রশ্নই অাসেনা।তুরস্কের অাইন এ ব্যাপারে যথেষ্ট কার্যকরী।

যাহোক যথেষ্ট ঘোরাঘুরি অার খাওয়াদাওয়া হল।তুরস্কে ঈদের চার দিন সরকারি যানবাহনে যাতায়াত ফ্রি থাকায় ঘোরাঘুরিতে যোগ হয় বাড়তি মজা। প্রায় ৬০ টি দেশের ভিন্ন ভিন্ন পোষাক পরিহিত ছাত্রদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সুযোগ এনে দিল এই পবিত্র ঈদ-উল -অাযহা। এত বন্ধু-বান্ধব,এত মানুষ,ভিন্ন ভিন্ন সঙস্কৃতি -যেখানে শেখার অাছে অনেক কিছু। সামাজিক জীব হিসেবে সব অনুভূতির ছিলনা কোন কমতি।কমতি রয়ে গেল শুধু একটাই- এখানে যে অাপনজন কেউ নেই।ঈদের নামায শেষে বাড়িতে এসে মায়ের হাতে রান্না সেমাই,মাংস -খিঁচুড়ি ও নেই। এখানে অনেক খাবার খেলাম ইচ্ছেমত।

খাবারের সংখ্যা ও গুণগত মানের দিক থেকে তুরস্কের খাবার জগৎ জোড়া।বিশেষ করে তুরস্কের মিষ্টান্ন (বাকলাভা) তুরস্কের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপে ও বেশ খ্যাতি লাভ করেছে।

এত কিছুর পরও অতৃপ্তির লেশ থেকেই যায়, যা তুরস্ক কেন পৃথিবীর কোন দেশেই মেটানো সম্ভব নয়।অার এজন্যই মনে হয় ‘মাতৃভূমি ‘নামক শব্দটার উৎপত্তি।
শত অানন্দের মাঝেও নিজের অজান্তেই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতার সেই লাইনগুলো মনে পড়ে যায়……..
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে অামার জন্মভূমি।(বাংলাদেশ)

পছন্দের আরো পোস্ট