আমি আর আমার জীবনের লক্ষ্য

ar4হঠাৎ কি ভেবে আজ কেন জানি নিজের জীবনের অব্যক্ত কথাগুলো বলতে ইচ্ছা করছে, তাই চেপে না রেখে বলছি। দশ জনের মতো আমার জন্ম অজপাড়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছোটখাট চাকরি করতেন, এখন স্ব-ইচ্ছাই কৃষক, মা গৃহিণী আর ছোট একটা বোন-এই আমাদের পরিবার।

 

ছোটবেলা থেকেই আমাদের শিশুদের কর্ণকুহরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়- তোমাকে ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ছোটবেলা থেকে আমাকেও বলা হয়, তোমাকে ডাক্তার হতে হবে! প্রখর রোদ আর ধুলোমাখা রাস্তায় পথ হেঁটে হেঁটে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পর্দাপন। অত:পর তৃতীয় শ্রেণীর সমাপ্তির সাথে সাথেই তিন কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে কিল্ডার গার্ডেনে অধ্যায়ন শুরু। কিল্ডার গার্ডেনে পড়া অবস্থায় এক শিক্ষক প্রশ্ন করেছিলেন, তোমার জীবনের লক্ষ্য কি? শিক্ষকের প্রশ্নে নিজ ইচ্ছাই বলে ছিলাম আমি পুলিশ হবো। কারণটা অবশ্য আমার জানা ছিল না।

 

কিল্ডার গার্ডেনে পড়া অবস্থায় পড়ালেখা গোল্লাই যাচ্ছিলো। এমন অবস্থায় বাবা জোর করে থানার সরকারী স্কুলে (শিবগঞ্জ সরকারী মডেল হাই স্কুল) অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন। স্কুলের পাশেই বাসা ভাড়া করে রেখে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, ভাল করে পড়, তোমাকে ডাক্তার হতে হবে!

 

বাবার ইচ্ছা কিছুটা পূরণ করলাম, সর্বোচ্চ রেজাল্ট নিয়ে স্কুল ছেড়ে অনিচ্ছা স্বত্তে¡ও রাজশাহী আসলাম। রাজশাহী সরকারী সিটি কলেজে দেখতে দেখতে দুই বছর কাটিয়ে দিলাম। কলেজে পরীক্ষা ছাড়া ক্লাসের উদ্দেশ্যে দশ দিন গেছিলাম কিনা সন্দেহ আছে। মেসে থাকতাম আর প্রাইভেট পড়েই কাটতো দিন। অবশেষে স্কুলের মতোই সর্বোচ্চ রেজাল্ট নিয়ে কলেজ ছাড়লাম।

 

কলেজ পাশ করার পর থেকে শুরু হলো ডাক্তার হবার সর্বোচ্চ চেষ্টা। প্রথমবার মেডিকেলে পড়ার কোন সুযোগ হলো না। বন্ধুদের পরামর্শে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) পরীক্ষা দিলাম। বাকৃবিতে চান্স পেলাম, অনেকটা জোর করেই বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভেটেরিনারি অনুষদে ভর্তিও হলাম। বাবা তখনো পিছু ছাড়েনি। তিনি জানালেন, সেকেন্ড টাইম মেডিকেলে পরীক্ষা দাও নইলে প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হও। বাকৃবির মনোমুদ্ধকর সৌন্দর্য, প্রিয় আশরাফুল হক হল আর বন্ধুমহলের কথা ভেবে সেদিন বাবার কথা শুনিনি।

 

Post MIddle

শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। প্রথম বর্ষে থাকা অবস্থায় মনস্থির করলাম রাজনীতি করবো, নেতা হবো। সে আশায় দীর্ঘদিন মিছিলের সামনে থেকে শ্লোগান দিয়েছি, জব্বার-কে.আর মার্কেটে শোডাউন দিয়েছি। কিন্তু সার্বিক পরিস্তিতি বলছিলো, রাজনীতি তোমার দ্বারা সম্ভব নয়।

 

এ্যানাটমি, হিস্টোলজির মতো আজীব বিষয়ে ক্লাস আর ঘুরাঘুরি করেই কাটছিলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। এমন অবস্থায় এক সাংবাদিক ভাইয়ের সাথে পরিচয়। অত:পর রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে সাংবাদিকতা করার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে আসলাম বাকৃবির সাংবাদিক সমিতিতে। নিজের অযোগ্যতার ভারে সাংবাদিক সমিতি থেকেও বিদায় নিতে হয় খুব অল্প দিনেই।

 

একদিন সন্ধ্যা বেলায় এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন করে প্যারাসাইটোলজি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক ড. সহিদুজ্জামান তার চেম্বারে ডাকলেন। সবুজবাংলাদেশ২৪.কম নামে নতুন এক অনলাইন পোর্টাল চালান তিনি। তার পোর্টালে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অফার দিলেন, অত:পর সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি। সেদিন থেকে আজ অবধি বিনা পারিশ্রমিকে সাংবাদিকতা আর পরীক্ষাকালিন পড়ালেখা করেই কাটছে আমার দিন। লোকে বলে, সাংবাদিকতায় নাকি নানান হুমকি আসে, কখনো আবার মারও খেতে হয়। মার খাইনি তবে হুমকি পেয়েছি। সেদিক দিয়ে সাংবাদিকতায় আমার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে অনেক আগেই।

 

ক্লাসে শিক্ষকরা প্রায় উচ্চস্বরে বলেন, তোমাদের ডিভিএম ডিগ্রী দেওয়া হবে। ডিভিএম হচ্ছে বিশ্বেও সবচেয়ে সম্মানীয় ডিগ্রী। কিন্তু আমি জানি, আমার ডিভিএম ডিগ্রীর ওজন অনেক হালকা হবে। না শিক্ষক হতে পারবো, না কোন ভাল ডাক্তার। তাই এসব কথাই আমার কিছু আসে না। বাড়িতে গেলে বাবা প্রায়ই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমার বোনকে বলেন, তুই ভাল করে পড়, একজন তো গরুর ডাক্তার হয়েছে, তোকে আমি মেডিকেলে পড়াবো, ডাক্তার বানাবো। কষ্টে বুকটা ফেটে যায়, কেননা আমি গরুর ডাক্তার হবো, মানুষের না! মানুষের ডাক্তার হতে না পারার কষ্টটা আজও পিঁছু ছাড়েনি।

 

জীবনের সর্বশেষ ইচ্ছা, নিজের এলাকায় একটা ভেটেরিনারি ক্লিনিক দিব। সেখানে স্বল্পখরচে গ্রামের মানুষের পশু-পাখির চিকিৎসা করবো। এই স্বপ্ন সত্তি হবে কিনা সে নিয়ে সন্দেহ আছে প্রকট কেননা আমাকে আমার জীবনের লক্ষ্য নানান সময় নানা ভাবে পরিচালিত করছে। তাই জীবনকে ছেড়ে দিয়েছি তার আপন গতিতে, দেখিনা সে আমাকে কোথাও নিয়ে যায়!

 

লেখাপড়া২৪.কম/রহমান/এমএএ-০৩৮১

পছন্দের আরো পোস্ট