খুলনা বিশ্বাবিদ্যালয়ের ৫ম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম সমাবর্তন বুধবার (২৫নভেম্বর) বিকেল ৩ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ।
তিনি তাঁর ভাষণে বলেন তরুণ প্রজন্ম আমাদের মূল্যবান মানব সম্পদ। তাদের হাত ধরে দেশ আগামীতে এগিয়ে যাবে। এই যুবসমাজই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর দীর্ঘদিন ধরে পরাজিত শক্তি তরুণদের নানাভাবে বিপদগামী করার চেষ্টা করছে এবং এখনও অব্যাহত রেখেছে। তরুণ প্রজন্ম যাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে এবং দেশ প্রেমের মহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারে সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের বিচিত্র ভাবনার বিস্তার ও অভিনব উদ্ভাবন কৌশলের দিক নির্দেশনা দিতে হবে। সরকার তরুণদের বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে সমতালে চলতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি গ্রহণ করছে। এই কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। মহান ভাষা-আন্দোলন, স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ছাত্র সমাজের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। সে গৌরবময় ঐতিহ্যকে ধারণ করে ছাত্র সমাজ জাতি গঠনে অবদান রাখবে জাতি তা প্রত্যাশা করেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সনদপ্রাপ্ত গ্রাজুয়েটদেরকে দেশের উচ্চতর মানব সম্পদ বলে আখ্যায়িত করে রাষ্ট্রপতি বলেন, তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। সে প্রত্যাশা পূরণে তাদের অর্জিত জ্ঞান, মেধা ও সৃজনশীলতাকে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিয়োজিত করার আহবান জানান। তিনি বলেন তাদের মনে রাখতে হবে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত উত্তরসূরী তারা। তারা এদেশকে এগিয়ে নিবে সুন্দর আগামীর পথে, সমৃদ্ধির পথে। তিনি আরও বলেন মনে রাখবে এ দেশ ও সমাজ আজ তোমাদের এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তাদের কাছে তোমরা ঋণী। তোমরা তোমাদের অর্জিত জ্ঞান, মেধা ও মনন দিয়ে দেশ মাতৃকার কল্যাণ করতে পারলে সেই ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে। আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। সে লক্ষ্য অর্জনে তোমরা অবদান রাখবে জাতি তা প্রত্যাশা করে।
রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণের শুরুতে পরম শ্রদ্ধার সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে বলেন তিনি অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং জেল-জুলুম উপেক্ষা করে বাঙ্গালী জাতিকে স্বধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। তিনি জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের স্মরণ করেন করে বলেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে খুলনা অঞ্চলের জনগণের রয়েছে বিপুল অবদান। তিনি বলেন হানাদার বাহিনীর বর্বরতার স্বাক্ষর বহন করছে গল্লামারী বধ্যভূমি। তিনি বরেন ১৯৮৭সালে প্রতিষ্ঠার পর সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ বজায় রেখে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কার্যক্রমের রজতজয়ন্তী পূর্ণ করলো। এটি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষার ইতিহাসে এক অনন্য অর্জন। জ্ঞান বিজ্ঞানের নবতর শাখার বিকাশ ঘটিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তোরত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেন। রাষ্ট্রপতি বলেন স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ জন্য তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয় করণ করেন। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেন যে শিক্ষাই জাতির মেরুদ- এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষা বিস্তারের কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ আজ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন স্বাধীনতার পর আমাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার মূলে শিক্ষাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি আরও বলেন দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও এ কথা ঠিক যে, শিক্ষার গুণগতমান এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। এ প্রসঙ্গে তিনি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ভারতের সুপ-িত কৈলাশ সতীর্থ এর একটি উক্তি উল্লেখ করে বলেন ‘শিক্ষায় বিনিয়োগের রিটার্ন নয়গুণ’ গুণগত শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ রির্টান অর্জন করা সম্ভব। তিনি বলেন আদর্শ শিক্ষক-গবেষক জাতির মূল্যবান সম্পদ, অনুসরণীয় আদর্শ। শিক্ষক-গবেষকদের জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রজ্ঞা ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। তাই শিক্ষার মান্নোয়নের প্রয়োজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ও জ্ঞানের প্রতি গভীর অনুরাগী শিক্ষকম-লী যারা নিজেরা নিরন্তর সর্বশেষ জ্ঞান চর্চায় রত থাকবেন এবং তা শিক্ষকদের মধ্যে বিতরণ করবেন। তবে বাস্তব অবস্থার নিরীক্ষে দেখা যায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্বস্তরেই প্রয়োজনের তুলনায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অপ্রতুলতা রয়েছে। এ অবস্থা দূরীকরণে শিক্ষাঙ্গনে প্রকৃত শিক্ষানুরাগীদের নিয়োগের পাশাপাশি তাঁদের উচ্চতর গবেষণা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষক যখন তাঁর মহান আদর্শ থেকে দূরে চলে যান, তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার নেতিবাচক প্রভাব পরে। তাই আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণে শিক্ষক ম-লী নিবেদিত থাকবেন জাতি তা প্রত্যাশা করে। তিনি শ্রেণী কক্ষে পাঠদানের মধ্যে শিক্ষকদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ না রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়ার আহবান জানান। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত বলে তিনি উল্লেখ করে বলেন সফল গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত জ্ঞান মানব জাতির অশেষ কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। চিকিৎসাসহ জীবনমান সহজ করতে পারে। চিকিৎসাসহ জীবনমান সহজ করতে পারে, এমনকি বিশ্বরাজনীতি, ভূ-অর্থনীতি, বিশ্ববাণিজ্য, আঞ্চলিক বা দেশীয় আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন সাধন করতে পারে। তবে গবেষণা যাতে আন্তর্জাতিক মানের হয় এবং জীবনমূখি ও মানব কল্যাণে নিবেদিত হয় সেদিকে সবিশেষ নজর দিতে হবে। তিনি বলেন খুলনা অঞ্চলে রয়েছে জীববেচিত্র্যে সমৃদ্ধ সুন্দরবন ও সামাদ্রিক সম্পদ সমৃদ্ধ বিশার উপকূল। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকদের প্রতি এ জীববৈচিত্র্য ও উপকূলীয় মূল্যবান সম্পদ বিষয়ে গবেষণা জোরদারের আহবান জানান।
এর আগে রাষ্ট্রপতি সমাবর্তন শোভাযাত্রাসহ প্যান্ডেলে প্রবেশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে তিনি নবনির্মিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের উদ্বোধন ফলক উম্মোচন করেন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান তার সমাবর্তন বক্তৃতায় বলেন, বহুকাল ধরেই আমার মনে হয়, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতের চাহিদার চেয়ে উচ্চশিক্ষার চাহিদা বেশি। উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলেই বাংলাদেশে আজ ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। তাদের জন্যে উচ্চশিক্ষার দাবি প্রবল হচ্ছে। সেসব ক্ষেত্রে শিক্ষার যথার্থ উপকরণÑগবেষণাগার ও গ্রন্থাগার প্রভৃতিÑপর্যাপ্ত থাকা চাই, উপযুক্ত শিক্ষক চাই। সবসময়ে আমরা তার জোগান দিতে পারি না। ফলে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান থেকে বের হলেও উচ্চশিক্ষালাভ অনেক সময়ে হয়ে ওঠে না। তিনি আরও বলেন উচ্চশিক্ষা অধিকার নয়Ñ তা মেধাবীদের জন্যে বাঁধা থাকে। অধিকার হলো প্রাথমিক শিক্ষা। এখন সবাই মেনে নিয়েছেন যে, আমাদের দেশে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যে-প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলিত আছে, তা অপর্যাপ্ত। এটাকে আরো তিন বছর বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে আমরা প্রাথমিক শিক্ষা বলব। এই প্রাথমিক শিক্ষালাভ সকল নাগরিকের অধিকার। আমাদের রাষ্ট্র এখনো সে-অধিকার সবাইকে দিতে পারেনি। এর ব্যবস্থা সবার আগে করতে হবে। তিনি বলেন এটা খুব আনন্দের বিষয় যে, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তির হার সন্তোষজনক গতিতে বাড়ছে। বিশেষ করে, মেয়েদের ভর্তির হার খুব আশাপ্রদ। এদের সবার শিক্ষা কি এখানেই শেষ হবে? এরা কি উচ্চশিক্ষা নেবে না? এর উত্তর এক কথায় দেওয়া যায় না। শিক্ষার একটা স্তর সফলভাবে শেষ করলেই যে-সকলে উচ্চশিক্ষালাভের যোগ্য হয়ে ওঠে না, একথা আমাদের বুঝতে হবে। দ্বিতীয়ত, সকলকেই সাধারণ শিক্ষা নিতে হবে কেন? আমরা যদি শিক্ষার একটা স্তরে বৃত্তিমুখী শিক্ষা চালু করতে পারতাম, তাহলে সকলে সাধারণ শিক্ষার দিকে না ঝুঁকে সেদিকে যেত। অন্তত অনেকে যেত। তাতে তাদের উপকার হতো, উচ্চশিক্ষার ওপর অহেতুক চাপ কমত। আমরা যেমন সকলকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে পারছি না, তেমনি বিকল্প শিক্ষার পথও তেমন করে খুলে দিতে পারছি না যাতে অনেকে নিজেরাই নিজেদের রোজগারের পথ খুঁজে পেতে পারে। অনেকেই কোনো বিষয়ের প্রতি যথার্থ আগ্রহী না হয়েও উচ্চশিক্ষা নিতে আসে। কেননা তার সামনে অন্য পথ খোলা নেই। এরা ছাত্ররূপী বেকার। বেকারত্ব চাপা দিয়ে রাখতে অধ্যয়নে আসা।
তিনি বলেন সব বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা এক ছাঁচে বেঁধে ফেলতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুল করি। এই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েই ¯œাতক পর্যায়ে কিছু কিছু বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছিল, যা তখন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না। এখন বোধহয় তার অনেকগুলিই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদানের ক্ষেত্র নয়, নতুন জ্ঞানসৃষ্টিই তার বড়ো কাজ। তাই গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ সেখানে থাকতে হবে, গবেষণার ফল প্রকাশ করতে হবে, সবাই দেখবে আমরা নতুন কী করলাম। সারা পৃথিবীতে এখন জ্ঞানের যে-বিস্ফোরণ ঘটছে, তা বিস্ময়কর। পৃথিবীর এককোণে বসে আমরা সেই জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হতে চাই। তার সঙ্গে নিজেদের সৃষ্ট জ্ঞান যুক্ত করতে চাই। একথা জানতে হবে যে, জ্ঞানের সৃষ্টি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নয়, সমাজ ও দেশের প্রয়োজন। সমাজ যদি জ্ঞানভিত্তিক না হয়, তার অগ্রগতি থেমে যেতে বাধ্য। জ্ঞানের অগ্রগতির অপরিহার্য শর্ত মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা, সব বিষয়ে প্রশ্ন করা। বাংলাদেশে আজ যে-ধরনের পরিবেশসৃষ্টির চেষ্টা চলছে, তা মুক্তবুদ্ধি চর্চার অনুকূল নয়। এই অবস্থা আমাদেরকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে টানবে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের যে-স্বাধীনতা সংবিধান আমাদের দিয়েছে, আমরা তা প্রয়োগ করতে চাই। তিনি কামনা করেন যে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার যথার্থ ক্ষেত্র হয়ে উঠুক।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ মজ্ঞুরী কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন যে, খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের পঁচিশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। রজতজয়ন্তীর এ প্রেক্ষাপটে দেশের তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উচ্চশিক্ষার বিকাশে স্থানীয় সম্পদ আহরণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন জনসম্পদ সৃষ্টি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধির সোপানে এগিয়ে নেওয়া এবং সম্ভাবনার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া সত্যি গৌরবের বিষয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ১৯৮৭ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। অনেক বছর যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই দিনটিকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে । আবার আজই ৫ম সমাবর্তন অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রপতির সম্মতির কারণে এই যুগলবন্দী সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি অঞ্চল তথা জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার অভ্যন্তরে যেমন বহুমতের লালন করে, তেমনি ঐ এলাকার মানুষের মধ্যে শুভবোধ জাগ্রত করে। বিশ্ববিদ্যালয় জাগতিক বিষয়ে চর্চার এক অনবদ্য ক্ষেত্র। হিংসা-বিদ্বেষ-পরশ্রীকাতরতা, সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রতার বিপরীত ক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়।, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় তার জন্মের ২৫ বছর পূরণ করছে। ৪টি ডিসিপ্লিন নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় এবং এখন এখানে ২৬টি ডিসিপ্লি ও ১টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। আরো একটি ইনস্টিটিউটের অনুমোদন আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি, যা অচিরেই চালু হবে। তিনি বলেন ঢাকায় বিভিন্ন দপ্তরে গেলে সরকারের উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা বলেন যে, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা যথেষ্ট ভাল করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিনের ছাত্ররা এড়ড়মষব-এ অনেক বড় দায়িত্ব পালন করে। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই ‘মাইক্রোসফট’ এবং ‘ওরাকল’ এর মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত রয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থপতিগণ দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করছেন। এটি তার মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ তৈরি করে। একটি নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এত তাড়াতাড়ি জাতির দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারে তা ভেবে তিনি সত্যিই তৃপ্তি অনুভব করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, গত ২৫ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন রাজনীতি বিবর্জিত সমাজ বা রাষ্ট্র স্থবির, গতিহীন ও প্রাণহীন। তারপরও এখানে জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করার মতো ছাত্রসংগঠন অনুমোদিত নয়। তবে আমাদের গ্রাজুয়েটবৃন্দ রাজনীতি সচেতন নয়, তা বলা যাবে না। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের আওতায় তারা সকল ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে থাকে। এই দেশমাতৃকা ও এদেশের আপামর দুঃখী মানুষের জন্য যা কিছু মঙ্গলময় ও কল্যাণকর সে বিষয়গুলোকে তারা নিবিড়ভাবে চর্চা করে।
তিনি উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জাপান থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন ‘আমার দেশের মাটি জাপান থেকে অনেক উর্বর। প্রতি হেক্টর জমিতে জাপানের চেয়ে আমার দেশে কেন দ্বিগুণ ফসল উৎপাদন হবে না’। আজ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকেও অতিক্রম করেছে। এর পেছনে বড় অবদান কৃষিবিদদের। এর প্রধান অনুপ্রেরক ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং বর্তমানে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কৃষি ও কৃষকের মর্যাদা তিনি যেখানে নিয়ে গেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন অন্য কেউ ততটা করতে পারেননি। কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো ডিসিপ্লিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। কিন্তু তাদের মাঠগবেষণার জন্য জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। যেখানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২০০ একরের বেশি জমি সেখানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে জমি মাত্র ১০৫.৭৫ একর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ ও মাঠ গবেষণার জন্য তিনি আরও কমপক্ষে ৫০ একর জমির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সরকারের আমলে প্রদত্ত ৮০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে উল্লেখ করে বলেন তা সত্ত্বেও এখনও শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম সংকটের কারণে সময়ের সাথে সংগতিপূর্ণ নতুন ডিসিপ্লিন খোলা কষ্টকর হচ্ছে। গবেষণাগারের অপ্রতুলতা, শিক্ষকবৃন্দের বসার জায়গার অভাব প্রকট। এত বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টিএসসি বা অডিটোরিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি টিনশেডের নিচে মেডিকেল সেন্টার, যেখানে মাঝে মাঝেই বিষধর সর্প অবস্থান নেয়। শিক্ষকদের মাত্র ৩টি ছোট আবাসিক ভবন; যেখানে মাত্র ২০ জন শিক্ষক পরিবার নিয়ে থাকতে পারেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ছোট্ট দুটি ইমারত রয়েছে। নবীন শিক্ষকদের জন্য একটি ডরমিটরির কাজ শুরু হয়েছে; তবে অর্থাভাবে এটি সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। এ সকল সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকার একটি প্রকল্প জমা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রী সদয় হলে এই প্রকল্পটি অনুমোদিত হতে পারে। এ দুটি বিষয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি ও সানুগ্রহ আনুকূল্য কামনা করেন।
গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন তোমাদের জীবনের আজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে তোমরা সনদ গ্রহণ করছো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হয়তো তোমাদের প্রত্যাশিত সকল সুবিধা প্রদান করতে পারিনি। রাষ্ট্রের সীমিত সম্পদের মধ্যে আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। যতটুকু সুবিধা তোমরা পেয়েছ-তা এদেশের কৃষক-শ্রমিকের করের টাকায় প্রদান করা হয়েছে। তোমরা জীবনে অ-নে-ক বড় হবে, ঘর্মাক্ত দেহের মানুষগুলোকে মনে রাখবে। একটা বিষয় তোমরা খেয়াল করবে-একজন রিক্সা বা ভ্যান চালক ৫ টাকা অতিরিক্ত দাবি করলে আমরা তাকে ভর্ৎসনা করি। কিন্তু আমাদের মতো স্যুট পরা মানুষেরা অবৈধ উপার্জনের লোভে দিনের পর দিন ছোট ছোট কর্মচারিদের ফাইল আটকে রাখে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম এবং এর নেপথ্যে ক্রিয়াশীল থাকে যে আভ্যন্তরিক চক্র তাকে মোকাবেলা করে সুষ্ঠুভাবে কাজ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ নিত্যই রাষ্ট্রীয় আয়ের একটি বড় অংশ এই চক্রের তৈরি করা সিস্টেম লসে চলে যায়। এ যে গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে কতো বড় অন্যায় উপাচার্যের দায়িত্ব না পেলে তা আমার অজানাই থাকত! আমি বিশ্বাস করি তোমরা যেখানেই থাকবে বাংলাদেশের এই ঘামঝরানো মানুষগুলোর কথা মনে রাখবে এবং তোমরা এইসব কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত থাকবে। তিনি আশা করেন তারা তাদের জীবনে এমন কিছু করবে না-যাতে এই বাংলা মায়ের বদন মলিন হয়। তোমরা বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলাদেশকে ও এদেশের মানুষকে একান্ত নিজের মনে করবে।
তিনি গ্রাজুযেটদের উদ্দেশ্যে বলেন তাদেরকে এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি হৃদয় দিয়ে ভালবাসেন। তার সাধ্য ও যোগ্যতার সবটুকু তিনি দেবার চেষ্টা করেছেন। এখানে রাষ্ট্রের একটি পয়সার যাতে অপচয় না হয় সে ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন। অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ বক্তৃতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার খান আতিয়ার রহমান
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত যে সমস্ত শিক্ষার্থীর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তাদেরকে রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে ডিগ্রির স্বীকৃতিস্বরূপ অভিজ্ঞানপত্র (সনদপত্র) প্রদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫টি স্কুলের ডিনবৃন্দ ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক স্ব স্ব স্কুল ও ইনস্টিটিউটের গ্রাজুয়েটদের রাষ্ট্রপতির সামনে উপস্থিত করেন। মূল অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করেন রেজিষ্ট্রার(ভারপ্রাপ্ত) টিপু সুলতান।
অনুষ্ঠানে ০১ জনকে পিএইচ ডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত হলেন মোঃ হাসানুজ্জামান। এছাড়া ১৪ জনকে গোল্ড মেডেল প্রদান করা হয়। বিজ্ঞান প্রকৌশল ও প্রযু্িক্তবিদ্যা স্কুলের- ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের উজ্জ্বল বিশ্বাস, গণিত ডিসিপ্লিনের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের রীনা পারভীন, গণিত ডিসিপ্লিনের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের আফরোজা পারভীন, পদার্থ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের মোঃ ইমরান হোসেন।
জীব বিজ্ঞান স্কুলের- ফিসারিজ এন্ড মেরিণ রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের জয়ন্ত বীর, এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শেখ মোজাম্মেল হোসেন, ফিসারিজ এন্ড মেরিণ রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শারমীন আক্তার, এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের জয়দেব গোমস্তা।
ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন স্কুলের- ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিনের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের মোঃ রুবেল হাসান বাপ্পী, ২০১১-১২ শিক্ষবর্ষের জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টি, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের মোহাইমিনুল ইসলাম।
সামাজিক বিজ্ঞান স্কুলের- অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের অপূর্ব রায়, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের নুসরাত জাহান।
চারুকলা ইনস্টিটিউটের- প্রিন্ট মেকিং ডিসিপ্লিনের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের লুৎফন্নাহার লিজা।
অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, সংসদ সদস্য যথাক্রমে খুলনা-১ পঞ্চানন বিশ্বাস, খুলনা-২ মোঃ মিজানুর রহমান মিজান, খুলনা- ৩ বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান, খুলনা-৪ মোস্তফা রশিদী সূজা, খুলনা-৬ মোঃ নূরুল হক, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিবসহ বেসামরিক, সামরিক উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, অর্থকমিটি ও প্লানিং কমিটিসহ অন্যান্য বডির সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কনভোকিগণ উপস্থিত ছিলেন।#
লেখাপড়া২৪.কম/খুবি/পিআর/আরএইচ-৪৭১০