বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের ভোটাধিকার

এস.এম. মিনহাজ কাদির।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সংসদীয় গণতন্ত্র এদেশে চালু রয়েছে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথে বাঁধা  এসেছে বারবার। স্বাধীনতোত্তর বাকশাল, সামরিক শাসন, গনতন্ত্রের নামে ভোট বিহীন নির্বাচন  ইত্যাদির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথকে পদে পদে বাঁধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এদেশের মানুষকে তাই বারবার জীবন দিতে হয়েছে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা,  স্বাধিকারের প্রশ্নে। ২০২৪ এর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন এরই উজ্জ্বলতম উদাহরণ। এ আন্দোলনে অংশ নেয়া শহিদ, পঙ্গু ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

এখন প্রসঙ্গে আসা যাক। গণতন্ত্রের মূলকথা হলো জনগণের শাসন। জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে এ শাসন ব্যবস্থায় সক্রিয় অংশ নিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম ভাগের ১২১ এবং ১২২ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকের ভোটাধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে। সুতরাং ভোটাধিকার বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু জনগণের উপর আস্থার অভাবে অথবা ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য  বিভিন্ন সময়ে সরকার জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। ফলে দেশের নাগরিকদেরকে বারবারই আন্দোলন করে, জীবন দিয়ে ভোটাধিকার ফিরিয়ে নিতে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে যে বারোটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনটিই প্রশ্নাতীত হতে পারেনি।

এর মধ্যেও যে নির্বাচনগুলো মোটাদাগে গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে স্বীকৃতি পেয়েছে সে নির্বাচনগুলোতেও একটি বিশেষ শ্রেণির ভোটাধিকারের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে উদাসীন দেখা গেছে। এখানে বিশেষ শ্রেণি বলতে আমি নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত সকল পর্যায়ের দায়িত্বপ্রপ্ত ব্যক্তিদেরকে বুঝাচ্ছি। নির্বাচনি কাজে সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তা / কর্মচারী নিয়োজিত থাকলেও শিক্ষকরায় যেহেতু  সর্বোচ্চ সংখ্যক দায়িত্ব পালন করে থাকেন তাই শিরোনামে শিক্ষকদের কথা উল্লেখ করেছি। সরকারি / বেসরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও আনসার, পুলিশ সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত।

এসকল ব্যক্তিরা ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে নিজের ভোটাধিকার  তথা প্রতিনিধি নির্বাচনে কার্যকর অংশগ্রহণ করা হয়ে উঠে না। অথচ দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের মত প্রকাশের ও প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার রয়েছে।

এখন অনেকে বলতে পারেন যারা নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত থাকেন তাদেরও ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ আছে। তারা ইচ্ছা করলে পোস্টাল ভোট দিতে পারেন। কথা সত্য। ভোট দেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু আমার কথা হলো এ প্রকার ভোট বা ভোটের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কতজন জানেন? প্রতিবার নির্বাচনের সময় যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাতে পোস্টাল ভোট সম্পর্কে কতটুকু সচেতন করা হয়? গণমাধ্যমে পোস্টাল ভোটের প্রচার কতটুকু দেখা যায়? এ সম্পর্কে  যারা জানেন তাদের কতজনই বা এ অধিকার প্রয়োগ করছেন? আমি এই স্থানেই নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা দেখি।

অথচ ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (RPO), ১৯৭২’ এর ২৭ অনুচ্ছেদের ১ (খ) এবং ১ (গ) অংশে  যারা ডাকযোগ ব্যালোটে ভোট প্রদান করতে পারবেন তাতে দুই শ্রেণির ভোটারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার প্রথমটি হলো ‘কোনো ব্যক্তি তিনি যে ভোট কেন্দ্রে ভোট প্রদানের অধিকারী সেই কেন্দ্র ব্যতীত, অন্য কোনো ভোট কেন্দ্রে নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত আছেন।’ এবং দ্বিতীয়টি হলো ‘ বিদেশে বসবাসরত কোনো বাংলাদেশি ভোটার।’

প্রতি নির্বাচনে নিয়ম মেনে প্রজ্ঞাপন দিয়ে ডাকযোগে ভোট দিতে ইচ্ছুকদের নিকট আবেদন আহবান করা হয়। কিন্তু ফলাফল? ফলাফল শূন্য।  কারণ আবেদন করে বিভিন্ন প্রক্রিয়া মেনে ডাকযোগে ভোট দেবেন এমন উৎসাহী ভোটার এদেশে তৈরি হয়নি। তাছাড়া যারা ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন তারা ভোটের মাত্র কয়েকঘন্টা পূর্বে তার দায়িত্ব পালনের কেন্দ্র সম্পর্কে জানতে পারেন। ফলে এ সময়ের মধ্যে ডাকযোগে ব্যালট পাবার আবেদন করাও সম্ভব হয় না। এভাবে নষ্ট হয় একজন শিক্ষিত, বিবেচনাপূর্ণ নাগরিকের প্রতিনিধি নির্বাচনের সাংবিধানিক অধিকার। অথচ প্রতি নির্বাচনের আগে দায়িত্বপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করা হয় এবং নির্বাচন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

এ সময় যদি সরকার তাদের সকলের পোস্টাল ডাকে ব্যালট প্রপ্তির যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুযোগ দেন তাহলে নির্বাচনে দায়িত্বরত সকল নাগরিক তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।

কিছু দিন আগেই প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা এরূপ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।  আমার এ লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো সকল নাগরিকের ভোটাধিকার। সকলের এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় যদি আইনগত কোনো সংশোধন করতে হয় তবে তা করা উচিৎ বলে মনে করি। আগামী দিনের নির্বাচনে যেন প্রায় শতভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রকাশ করতে পারেন এটাই অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট প্রত্যাশা।

এস.এম. মিনহাজ কাদির
প্রভাষক,লাউড়ী রামনগর কামিল মাদ্রাসা।মণিরামপুর, যশোর।

পছন্দের আরো পোস্ট