পাবিপ্রবি উপাচার্য শিক্ষাবিদ ড. হাফিজা খাতুনের কর্মজীবন

পাবিপ্রবি প্রতিনিধি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সুনামধন্য শিক্ষাবিদ-গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন গত ১২ এপ্রিল পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৩ এপ্রিল তিনি যোগদান করেন। এই জ্ঞানী ও আলোকিত শিক্ষকের যোগদানের মাধ্যমে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আলোকিত হয়েছে তেমনি সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষার আদর্শ পরিবেশ। তাঁর বর্নাঢ্য কর্মজীবন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রানিত করবে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে।

ড. হাফিজা খাতুন ১৯৫৪ সালের ১২ জুলাই পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় তাঁর জম্ম ও বেড়ে ওঠা। মওলানা কবিরউদ্দিন রহমানী এবং বেগম ফয়জুন্নেছার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি সপ্তম। মওলানা কবির উদ্দিন রহমানী দিল্লীতে লেখাপড়া করেছেন। বেগম ফয়জুন্নেছা ছিলেন সভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর মা নজিবুন্ন্ছো ১৯২১ সালে নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জের মাসুমাবাদ গ্রামে মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একশ বছর আগে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিশেষভাবে তাৎপর্যময়। পরে স্কুলটি মাসুমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত লাভ করে। এটি এ অঞ্চলের মধ্যে পুরাতন বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে একটি। অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন পুরাতন ঢাকার মালীটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে, এরপর কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে।

তিনি ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীন নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী। তবে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ব্যাচ। তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর ও সামাজিক ভূগোল বিষয়ে ১৯৮৪ সালে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। ১৯৭৮ সালে ইউনিসেফ, নেপাল থেকে উন্নয়ন প্রকল্প এবং ১৯৮১ সালে ব্যাংককের এ এআইটি থেকে নগর উন্নয়ন ও গৃহায়নের উপর কোর্স করেন। তিনি বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা ব্লু ।

Post MIddle

ড. হাফিজা খাতুন ১৯৭৯ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর কুমুদিনী কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৫ সালে জুন থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত দূর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশ-বিদেশে নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। ড. হাফিজা খাতুন ২০১৯ সাল থেকে চীনের নানজিং এর হোহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনবার্সন জাতীয় গবেষণা কেন্দ্রের একাডেমিক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ-সায়েন্স জার্নাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ এন্ড ইনভায়রনমেন্ট সায়েন্স জার্নাল, বাংলাদেশ জিওগ্রাফি সোসাইটির- ওরিয়েন্টাল জিওগ্রাফার, ভূগোল ও পরিবেশ জার্নালের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগের প্রতিবেশ জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ড সদস্য। ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন। ৮০টির বেশি স্নাতকোত্তর পর্যায়ের গবেষণা পারচালনায় তদারকি করেছেন। তাঁর প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের অর্ধশতাধিক কনফারেন্সএ অংশগ্রহন করেছেন। তিনি সামাজিক সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং ভূমি অধিগ্রহণ, উন্নয়ন কার্যক্রম, বাংলাদেশের পুনবার্সন সংক্রান্ত সমস্যা সম্পর্কিত নীতি এবং পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অবদান রেখে চলেছেন। নয়টি বইয়ের রচয়িতা। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা,ব্রাজিল,মেক্সিকো, জার্মানি, যুক্তরাজ্য,পতুর্গাল, গ্রিস, নেদারল্যান্ড, রাশিয়া, উজবেকিস্তান, তুরস্ক,ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, ফিলিপাইন,চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত,কাতার, অষ্ট্রেলিয়া ভ্রমন করেছেন।

তিনি শিক্ষকতা ও গবেষণা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। কানাডার মাঠ পর্যায় থেকে ডাইনোসরের ফসিল সংগ্রহ করে বিনামূল্যে জাতীয় যাদুঘর ও বিজ্ঞান যাদুঘরে পরিদর্শনের জন্য দান করেছেন। নদী বাঁচাও আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে নদী রক্ষার আন্দোলনের অগ্রপথিক। তাঁর দেখানো পথে আজ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নদী রক্ষারবোধ জাগ্রত। সারাদেশে নদী রক্ষা আন্দোলন বেশ সাড়া ফেলেছে। আঞ্জুমান মফিদুলের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য হিসেবে অসহায় দরিদ্র মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাথে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন অ্যালামনাইসহ ১৪টি সোসাইটির সাথে জড়িত। বিভিন্ন গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাতটি ট্রাষ্টফান্ড প্রতিষ্ঠা করে দেশ ও সমাজের উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। দুটি ট্রাষ্ট পিতা মাতার নামে ‘ফয়জুন্নেছা কবির উদ্দিন রহমানী মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠন করেছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং গাজীপুরের বড় কয়ের বিদ্যালয়ের জন্য। এই তহবিল ভালো ফলাফলের জন্য বৃত্তি ও স্বর্ণপদক প্রদান করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের কৃতি শিক্ষর্াীদের জন্য দুইটি ট্রাষ্ট ফান্ড গঠন করেছেন। এছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ‘হাফিজা খাতুন স্বর্ণপদক ট্রাষ্ট ফান্ড’ আরেকটি তহবিল গঠন করেছেন।

ড. হাফিজা খাতুনের জীবনের উজ্জলতম সময় ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তাঁর ভাই আবু রায়হান মাহমুদের সেক্টর-৩ এর অধীনে সিলেট ফ্রন্টে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাঁর আরেক ভাই আবুল হাসান মাসুদ ছিলেন সেক্টর -২ এর গেরিলাযোদ্ধা। তাঁর পৈতৃক নিবাস ৩৭, হাজী আব্দুল্লাহ সরকার লেন বংশাল ছিল (মাসুদ বাহিনীর) গেরিলা ইউনিটের কেন্দ্র। মাসুদ বাহিনীর গেরিলা কমান্ডার ছিলেন আবুল হাসান মাসুদ। মাসুদ বাহিনীর অন্যতম সদস্য হিসেবে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা, সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। তিনি ও তাঁর অন্যান্য ভাইবোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, ওষুধ সরবরাহ, প্রাথমিক চিকিৎসা, বার্তাপ্রেরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অস্ত্রবহনের কাজ করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী পুরান ঢাকার কোতোয়ালী থানাসহ আশেপাশের এলাকার আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য দায়িত্ব পড়ে মাসুদ বাহিনীর উপর। মাসুদ বাহিনীর ডানহাত হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন সে সময় আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

ব্যক্তিজীবনে অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন অধ্যাপক ড. মোঃ হযরত আলীর সঙ্গে। ড. মোঃ হযরত আলী ২০১৮ সাল থেকে ফাষ্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর উপাচার্য। এর আগে শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ এবং কৃষিবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁদের রয়েছে তিন সন্তান ও ছয়জন নাতি-নাতনী। প্রথম মেয়ে তানিয়া এ আলী অষ্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেন থেকে সিপিএ করা, দ্বিতীয় মেয়ে ড.তনিমা এস আলী সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ও রিসার্স ফেলো। ছেলে তাহসিন আলী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী।

পছন্দের আরো পোস্ট