কানাডায় স্কলারশীপ পাবেন যেভাবে

কানাডা ইমিগ্রেশনের সঙ্গে কানাডায় পড়াশোনা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। কেননা, কানাডার ডিপ্লোমা বা ডিগ্রির জন্য একজন ইমিগ্রেশন প্রত্যাশী অতিরিক্ত কিছু পয়েন্ট পেতে পারেন। ফলে, কানাডায় পড়াশোনা করলে কানাডা ইমিগ্রেশনের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। সম্ভবত এ কারণেই পৃথিবীর প্রথম তিনটি দেশের একটি কানাডা, যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিদেশী পড়াশোনা করতে যান।

বলা বাহুল্য, বৃত্তি নিয়ে এ পড়াশোনা সম্ভব হলে খরচ অনেকাংশে কমে যায়। সঙ্গতকারণে একজন কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি) হিসেবে আমার সঙ্গে বিভিন্ন দেশ হতে কানাডায় পড়তে আগ্রহী মানুষ যোগাযোগ করেন। এদের একটি অংশ আবার জানতে চান স্কলারশিপ নিয়ে কিভাবে কানাডায় পড়াশোনা করা যায়? সে বিষয়েই আজকের এ লেখা।

শুরুতেই দেখা যাক কানাডা কেন বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের সেদেশে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি দিয়ে থাকে? এর একাধিক কারণ। বহুবিধ কারণের মধ্যে কেবল কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা যাক-

একজন বিদেশী ছাত্রের পক্ষে কানাডায় পড়াশোনা ব্যয়সাধ্য। আর্থিকভাবে দুর্বল ছাত্রদের আংশিক বা পূর্ণ আর্থিক সহায়তা দেওয়া বৃত্তির প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য। এ বৃত্তি সরাসরি আর্থিক সহায়তা প্রদান বা, অন্যভাবেও হতে পারে। যেমন, পড়াশোনা চলাকালীন কানাডায় খন্ডকালীন চাকুরী করার সুবিধা দেওয়া, বা পড়াশোনা শেষে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কানাডায় পূর্ণকালীন চাকুরীর সুযোগ প্রদান। তবে, এসব ক্ষেত্রে কানাডা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত কিছু স্টাডি প্রোগ্রামে পড়াশোনা করতে হয়; বাছবিচার না করে যে কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোন স্টাডি প্রোগ্রামে পড়তে গেলে হবে না। আমাদের কোম্পানি, এমএলজি ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, এসব বিষয়ে ছাত্রদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে থাকে।

সরাসরি অর্থ সহায়তা দিয়ে যেসব বৃত্তি কানাডা দিয়ে থাকে তা বেশ প্রতিযোগিতামূলক। এ ধরণের বৃত্তির প্রাকযোগ্যতা ক্ষেত্র ভেদে বিভিন্ন হতে পারে। যেমন, কিছু বৃত্তির জন্য একটি ব্যক্তিগত প্রবন্ধের (ঢ়বৎংড়হধষ বংংধু) প্রয়োজন হতে পারে ।

কখনো শিক্ষক বা নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে রেফারেন্স চাওয়া হতে পারে। অন্য কিছু ক্ষেত্রে আবেদনকারীর একাডেমিক ফলাফলের পাশাপাশি এক্সট্রাকারিকুলার এক্টিভিটিজ, সমাজসেবামূলক স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ড ও সৃজনশীলতা ইত্যাদি বিবেচনায় এনে বৃত্তি দেওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, কানাডায় ছাত্ররা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত থাকে।

তবে, যারা কানাডা ইমিগ্রেশনের চিন্তা মাথায় রেখে লেখাপড়া ও বৃত্তির সন্ধান করেন তাঁদের একটি বিষয় আগে থেকেই জেনে নেওয়া উচিত। তা হলও, বৃত্তি গ্রহণ করে প্রার্থীর নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কোন শর্ত বৃত্তির আবেদনে জুড়ে দেয়া আছে কিনা। তেমন ক্ষেত্রে আপনাকে বৃত্তির শর্ত মেনেই কানাডা ইমিগ্রেশনের পরিকল্পনা করতে হবে। যেমন ধরুন, যদি শর্ত থাকে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে গিয়ে কমপক্ষে তিন বছর চাকুরী করতে হবে, তবে সে কাজটি আপনাকে করতেই হবে।

এ ধরণের বৃত্তি প্রদানের মূল উদ্দেশ্য দুটি: এক) তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণে সহায়তা দিয়ে দেশগুলোর সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা; দুই) বহির্বিশ্বে কানাডার শিক্ষা-প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটানো।

কানাডা সরকারের বাইরেও কানাডার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একাধিক উদ্দেশ্যে বাইরের দেশের ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দিয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে মেধাবী ছাত্রদের নিজেদের কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে উৎসাহিত করা। এ ধরণের বৃত্তির জন্য বিবেচিত হতে হলে একজন ছাত্রকে ভালো জিপিএ এবং উন্নত ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট স্কোর (যেমন, আইইএলটিএস) থাকতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরণের বৃত্তি ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই দেওয়া হয়না।

কানাডার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক বা দুই টার্ম পড়াশোনা করার পর ফলাফল দেখে দেওয়া হয়। ফলাফলের সঙ্গে বৃত্তি পাওয়ার শর্ত হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ড বা অন্যান্য শর্তও আবশ্যকীয় হিসেবে থাকতে পারে। নিচে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের একটি কলেজে বৃত্তি প্রদানের শর্তাবলী দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হলও।

একাডেমিক এডভান্সমেন্ট স্কলারশিপ এর প্রাকযোগ্যতা

– স্টাডি পারমিটের মাধ্যমে অধ্যয়নরত ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট (কানাডার পিআর, বা সিটিজেন নন এমন বিদেশী ছাত্র) হতে হবে।

Post MIddle

– কমপক্ষে দুটি সেমিস্টার সফলভাবে উত্তীর্ণ হতে হবে।

– জিপিএ ৭.০ (অ -) বা তার অধিক হতে হবে।

– কলেজের স্টুডেন্ট কম্যুনিটি সম্পর্কিত স্বেচ্ছাসেবী কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকতে হবে।

– বৃত্তির অর্থমূল্য: এককালীন ১,০০০ কানাডিয়ান ডলার; মোট সংখ্যা: ৫টি।

লক্ষ করুন, বৃত্তিগুলোতে পড়াশোনায় ভালো ফলাফলের পাশাপাশি ভলান্টিয়ারিংয়ের (স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ড) শর্তও জুড়ে দেওয়া আছে। তাই, কানাডায় বৃত্তি পাবার সম্ভাবনা বাড়াতে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত করতে পারে। তবে, এসব যেন কোনোভাবেই কাগজ-সর্বস্ব না হয়। ব্যাপক পরিচিতি আছে এমন সেবামূলক আন্তর্জাতিক সংগঠনে সম্পৃক্ততা, যা সহজে ভেরিফাই করা যায়, হতে পারে সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অকাট্য প্রমাণ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন স্টাডি প্রোগ্রামে আসন খালি থাকলেও তা বৃত্তি দিয়ে পূরণ করা হয়। ধরা যাক, আপনাকে সামান্য বৃত্তি বা কোন বৃত্তি না দিয়েই প্রথমে একটা স্টাডি প্রোগ্রামে ভর্তির অফার দেয়া হলও। কিছুদিন পর দেখা গেলো আপনাকে বৃত্তি দেয়া হয়েছে বা আপনার বৃত্তির পরিমাণ আরও বাড়ানো হয়েছে। তার মানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধারণা করছে ওই বিশেষ প্রোগ্রামে আসন খালি পরে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তেমন কিছু হলে যতই ক্লাস শুরুর দিন ঘনিয়ে আসবে ততই বৃত্তির পরিমাণ বা সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। অনেক সময় সরাসরি বৃত্তির পরিমাণ না বাড়িয়ে প্রার্থীকে দিয়ে এক বা একাধিক রচনা লিখিয়ে নেওয়া হয়। তারপর বৃত্তি কমানো হয় যাতে প্রার্থী মনে করেন তিনি ভালো রচনা লেখার কারণেই হয়তো বা বর্ধিত বৃত্তি পেয়েছেন। এভাবে শুধু একবার নয়, দুই বার বৃত্তির পরিমাণ বাড়াতেও আমরা দেখেছি। অর্থাৎ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক স্বার্থও বৃত্তি প্রদানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য।

অনেকসময় মার্কেটিং স্ট্রাটেজির অংশ হিসেবেও কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদেশী ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জরিপ চালিয়ে দেখে তাদের প্রতিষ্ঠানে কোন কোন দেশের ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি তুলনামূলক ভাবে কম। এভাবে বেছে বেছে কিছু দেশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তারা বৃত্তি ঘোষণা করে থাকে। দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশই এ সুযোগের আওতায় সচরাচর বিবেচিত হয় না। কারণ, এসব দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পৃথিবীর প্রায় সব দেশের স্কুল কলেজেই পড়ালেখা করে। ফলে, এসব দেশ হতে ছাত্র আকর্ষণ করতে মার্কেটিংয়ের তেমন প্রয়োজন পড়ে না।

এ লেখায় কানাডায় পড়াশোনার জন্য বৃত্তি সম্পর্কিত কিছু তথ্য উপস্থাপন প্রাসঙ্গিক হবে। কানাডায় বিদেশী ছাত্রদের বৃত্তির উৎস মূলত: দুটি।

এক) কানাডা সরকার

দুই) বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা সংগঠন।

গুগলে সার্চ দিয়ে আপনি বৃত্তির আরও সূত্র খুঁজে পেতে পারেন।

কানাডার বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকেও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য স্কলারশিপ আছে কিনা তা খুঁজে দেখা যায়।

কানাডায় যারা পড়াশোনা করতে আসে তাদের অনেকেরই স্বপ্ন থাকে কানাডায় ইমিগ্রেশন পাওয়া। তাই, বৃত্তির আবেদনের আগেই দেখে নেয়া উচিত ‘কানাডায় পড়াশোনা শেষে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া বাধ্যতামূলক’ তেমন কোন শর্ত জুড়ে দেয়া আছে কিনা? সেক্ষেত্রে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে শর্ত মেনে পরবর্তীতে কানাডা ইমিগ্রেশনের আবেদন করা যায়।

বলা বাহুল্য, বয়স বেড়ে গেলে কানাডা ইমিগ্রেশনের পয়েন্ট কমে যায় বলে শুরুতেই শর্তহীন বৃত্তি খুঁজে নেয়ার চেষ্টাই অধিকতর উপযোগী মনে করি। তাছাড়া, আপনাকে দেয়া স্টাডি পারমিটের প্রতিটি শর্তও অক্ষরে অক্ষরে পালন করা বাধ্যতামূলক। অন্যথায় পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট হলেও আপনার ওয়ার্ক পারমিট বা ইমিগ্রেশনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হতে পারে।

পছন্দের আরো পোস্ট