যে তিন কাজে ধৈর্য ধারণ জরুরি

ড. ইউসুফ আল কারজাভি

পবিত্র কোরআনে মানুষকে ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ধৈর্যধারণের গুরুত্ব ও পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে এসব পুরস্কার লাভের শর্ত হলো একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য তা করা। কেউ যদি এই চিন্তা থেকে ধৈর্য ধারণ করে যে মানুষ তাকে ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ বলবে, তাহলে সে আল্লাহর কাছে কোনো প্রতিদান পাবে না। বরং তা তার জন্য বিপদের কারণ হবে। আল্লাহ বলেন, ‘এবং যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ধৈর্য ধারণ করে, নামাজ কায়েম করে, আমি তাদের যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা ভালো দ্বারা মন্দ দূরীভূত করে, তাদের জন্য শুভ পরিণাম।’ (সুরা রাদ, আয়াত : ২২)

যেসব কাজে ধৈর্য ধারণ জরুরি :

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা যেভাবে মানুষকে ধৈর্যধারণের নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনি কোন কোন ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করতে হবে, তা বর্ণনা করে দিয়েছেন। যেমন—

১. জাগতিক বিপদে : এই পৃথিবী একটি পরীক্ষাগার। রোগ, বালাই, অসুস্থতা, মৃত্যু ও অভাবের মতো বিপদের দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করা হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই, পৃথিবীর প্রতি যার কোনো অভিযোগ নেই। জাগতিক এসব বিপদের সর্বোত্তম চিকিৎসা ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। আপনি শুভ সংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫-১৫৬)

২. প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে ধৈর্য : দুর্যোগপূর্ণ পৃথিবী মানুষের ভেতর টিকে থাকার দুর্বার ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে, যা একসময় তার ভেতর মোহ তৈরি করে। নারী, ধন-সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি ও খ্যাতির মোহ থেকে তার ভেতর জন্ম নেয় প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তি থেকে বাঁচা মানুষের জন্য কষ্টকর কাজ। এ জন্য প্রয়োজন হয় ধৈর্যের। ইরশাদ হয়েছে, ‘নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রুপা আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে। এসব পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহ, তাঁর কাছেই রয়েছে উত্তম আশ্রয়স্থল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৪)

তবে ইসলাম মানুষকে সীমার মধ্যে থেকে বৈধ উপায়ে তার চাহিদা পূরণের অনুমতি দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা খাও এবং পান করো; কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ব্যভিচারকে ভয় করে এটা তাদের জন্য; ধৈর্য ধারণ করা তোমাদের জন্য মঙ্গল। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ২৫)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘যদি তোমরা শাস্তি দাওই, তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। তবে তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্য তাইতো উত্তম।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১২৬)

Post MIddle

৩. আল্লাহর আনুগত্যে : আল্লাহ তাআলা বহু বিধান দান করেছেন। ব্যক্তি ধৈর্যশীল না হলে, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যেমন প্রচণ্ড শীতের মধ্যে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা, সম্পদের মোহ ত্যাগ করে জাকাত প্রদান করা, হজ ও জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও তাদের অন্তর্বর্তী যা কিছু, তার প্রতিপালক। সুতরাং তাঁরই ইবাদত করো এবং তাঁর ইবাদতে ধৈর্যশীল থাকো। তুমি কি তাঁর সমগুণসম্পন্ন কাউকে জানো।’ (সুরা মারিয়াম, আয়াত : ৬৫)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং তোমার পরিবারবর্গকে নামাজের আদেশ দাও ও তাতে (ধৈর্যসহ) অবিচল থাকো, আমি তোমার কাছে কোনো জীবনোপকরণ চাই না, আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দিই এবং শুভ পরিণাম আল্লাহভীরুদের জন্য।’ (সুরা তাহা, আয়াত : ১৩২)

আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্যধারণের ব্যাখ্যা : আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্যধারণের তিনটি পর্যায় হয়। তা হলো—

এক. আনুগত্যের আগে : ইবাদতের আগে নিয়ত বিশুদ্ধ করা এবং ইবাদতের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা ধৈর্যের অন্তর্ভুক্ত। কেননা জ্ঞানী মাত্রই জানেন নিয়তের বিশুদ্ধতা সৃষ্টি করা কোনো সাধারণ কাজ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামাজ কায়েম করতে। এটাই সঠিক দ্বিন।’ (সুরা বাইয়িনা, আয়াত : ৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমলের পরিণাম নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১)

দুই. আনুগত্যের সময় : শরিয়ত বহু বিধান প্রণয়ন করেছে এবং তার জন্য নির্ধারণ করেছে কিছু শিষ্টাচার। বিধান পালন করা যতটা সহজ, শিষ্টাচারগুলো মান্য করা ততটা সহজ নয়। উদাহরণস্বরূপ নামাজ পড়া খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু পাবন্দির সঙ্গে নামাজ আদায় করা, খুসু-খুজুর সঙ্গে নামাজ আদায় করা, শীতের ভেতর মসজিদে যাওয়া কঠিন কাজ।

তিন. আনুগত্যের পরে : মানুষ যখন কষ্ট সহ্য করে কোনো ইবাদত করে, তখন তার এই ইচ্ছা জাগ্রত হয় যে মানুষ তার ভালো কাজের প্রশংসা করুক, সমাজে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ুক। খ্যাতির এই মোহ মানুষের বহু মূল্যবান আমলকে মূল্যহীন করে ফেলে। তাই মুমিনের উচিত অন্তরে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে স্থান না দেওয়া। আল্লাহ তাআলা সবাইকে সঠিকভাবে ধৈর্যধারণের তাওফিক দিন। আমিন।

 

তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর । কালের কন্ঠের সৌজন্যে

পছন্দের আরো পোস্ট