জীবনে শ্রেষ্ঠ যে দশদিন
সাঈদা জাহান
অর্থনীতিতে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হল, ‘দেয়ার ইজ নো সাচ এ থিং অ্যাজ এ ফ্রি লাঞ্চ’। সোজা বাংলায় যাকে বলে ‘কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়’।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর মু’মিন বান্দাদের পুরস্কারস্বরূপ বছরের দুইটি শ্রেষ্ঠ দিন দিয়েছেন। ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা। আমরা সবাই একথা জানি যে ঈদ মানে আনন্দ এবং ঈদ মানে খুশি। আসলেই কি তাই? সবাই কি ঈদের দিন সেই আনন্দ ও খুশি হৃদয়ে অনুভব করি? এই আনন্দই বা কিসের আনন্দ? কোথায় এই খুশির উৎস?
এই খুশি বা আনন্দ হল- নিজের করা ইবাদাত কবুল হওয়ার আনন্দ! নিজের জানা-অজানায় করে ফেলা গোনাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার খুশি। তাই ঈদের সত্যিকারের খুশি পেতে হলে ইবাদাতের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
কোরআনে উল্লেখিত প্রায় সব বিষয়ই হচ্ছে শর্ত সাপেক্ষ (Conditional)। অর্থাৎ প্রত্যেক কাজের ফলাফল (প্রতিক্রিয়া) তার ক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। চেকলিস্ট ফুলফিল করলেই কেবলমাত্র ফলাফল পাওয়া যাবে। এই সিস্টেমের ব্যতিক্রম একমাত্র আল্লাহ্র রহমত ও ক্ষমা, যা কিনা যাবতীয় শর্তের ঊর্ধে (unconditional)। তাহলে ঈদের দিনে মনে আনন্দ বা খুশি অনুভব করার পূর্বশর্ত কী?
মুসলিমদের জন্যে দুই ঈদ হলো মূলত ইবাদাতের দুই ভরা মৌসুম। ঈদ-উল-ফিতরের আগে রয়েছে বছরের শ্রেষ্ঠ দশ রাত। আর ঈদ-উল আযহার আগে রয়েছে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়- বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিন।
ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যার আমল জিলহজ্জ মাসের এই দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হল এবং এর কোনো কিছু নিয়েই ফেরত এলো না (তার কথা ভিন্ন)।’ [বুখারী : ৯৬৯; আবূ দাউদ : ২৪৪০; তিরমিযী : ৭৫৭]
রামাদান মাস যেমন বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস তেমনি জিলহজ্জের এই দশদিন হচ্ছে বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিন। সকল মুফাসসির এ ব্যাপারে একমত যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনুল কারীমের সূরা ফাজরে যে দশ দিনের শপথ করেছেন তা জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন।
আমাদের কাছে জীবনের সেরা দিন কোনটি? কারো কাছে বাবা-মা হওয়ার দিনটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। আবার কারো কাছে গ্রাজুয়েট হওয়ার দিন কিংবা স্বপ্নের চাকরি প্রাপ্তির দিনটি তার জীবনের সেরা দিন। আর হাদীসে এসেছে, দুনিয়ার জীবনের শ্রেষ্ঠ দশদিন হচ্ছে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন! আর তাই বছরের শ্রেষ্ঠ এই দশ দিনের ইবাদাত আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভঃ ঈমান(কালেমা), নামায, যাকাত, রোজা, এবং হজ্জ। বছরে মাত্র একবার এই পাঁচটি ইবাদাতের চমৎকার সমন্বয় ঘটে কেবলমাত্র জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনে। বছরের অন্যান্য দিনের মতো এই সময় আমাদের ঈমান থাকে। আবার অন্যান্য সময়ের মতো এই দশ দিন নামায ও যাকাত আদায় করা যায়। এছাড়া আরাফার দিনের বিশেষ রোজা ছাড়াও হাদিসে এই দশ দিনের প্রতিদিন রোজা রাখার ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ রয়েছে। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ্জ এই সময়েই আদায় করা হয়। কোরবানী আদায় করা হয় এই দশকে। অর্থাৎ ইসলামে বর্ণিত ইবাদাতের পাঁচটি স্তম্ভ ছাড়াও আরো অনেক ইবাদাত এই দশদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেজন্যেই আল্লাহর কাছে এই দশ দিনের মাহাত্ম্য অনেক বেশি।
রামাদানের শেষ দশ রাতে যেমন রয়েছে হাজার মাসের থেকেও উত্তম রজনী শবে-কদর। তেমনি, জিলহজ্জ মাসের দশ দিনের মধ্যে রয়েছে আরাফার দিন। যে দিন আল্লাহর কাছে থেকে ক্ষমা ও মাগফিরাত পাওয়ার দিন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার দিন। জিলহজ্জ মাসের গুরুত্বের জন্যে এক আরাফার দিন থাকাই যথেষ্ঠ ছিল। সেই সাথে এই দশকেই আছে কোরবানীর দিন। একেবারে ইবাদাতে পরিপূর্ণ দশটি দিন।
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদ্বিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এই দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।” [মুসনাদ আমহদ : ১৩২; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ৩৪৭৪; মুসনাদ আবী আওয়ানা : ৩০২৪]
বছরের শ্রেষ্ঠ দশদিনের মাস- ”জিলহজ্জ” বাংলাদেশে চলতি জুলাই মাসের ১১ তারিখ (চাঁদ দেখা সাপেক্ষে) আজ রবিবার মাগরিবের পর থেকে শুরু হবে। এই দশদিন তওবা এবং দোয়া করার সুবর্ণ সময়। আমাদের উচিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এই ইবাদাতের মৌসুমকে স্বাগত জানাতে সুন্দর করে প্রস্তুতি নেয়া।
হাদীসে এই দশদিনের করণীয় ও বর্জনীয় ইবাদাত সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। এই দশদিনে একমাত্র বর্জনীয় কাজ হল- শরীরের চুল, লোম, এবং নখ না কাটা। বিশেষ করে যারা কোরবানী দিবেন। যাদের চুল, নখ কাটার প্রয়োজন জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার আগে কেটে নিলে উত্তম এবং খুব বেশি অপারগ না হলে এই ১০ দিন আর চুল, নখ কাটা যাবে না। হানাফি মাজহাব মতে যদি বড় হয়ে যায় তবে কাটতে পারেন।
সামর্থবানদের এই সময় হজ্জ এবং উমরা পালন করতে বলা হয়েছে।
যারা হজ্জ এবং উমরা পালন করতে পারবেন না তাদের উচিত এই শ্রেষ্ঠ দশদিনে যত বেশি সম্ভব রোজা রাখা। হাদিসে জিলহজ্জ মাসের এক তারিখ থেকে নয় তারিখ পর্যন্ত রোজা রাখতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে আরাফার দিনে রোজা রাখার ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। কেননা, আরাফার দিনের রোজা বিগত ও অনাগত দুই বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে কবুল হয়ে থাকে।
এছাড়া, বছরের অন্যান্য সময় আমরা যেসব ইবাদাত করে থাকি, যেমন- পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা, যাকাত দেয়া, দান-সাদাকা করা ইত্যাদি ইবাদাত এই সময়ে আরো বেশি মনোযোগ ও সুন্দর করে করা। বিশেষ করে বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা এবং দোয়া করা। দোয়া কবুলের জন্যে এর চেয়ে ভালো দিন আর হয় না।
জিলহজ্জের প্রথম দশদিন ব্যাপকহারে তাকবীর পড়া সুন্নত। বিশেষভাবে আরাফা দিন ফজরের পর থেকে মিনার দিনগুলোর শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ যেদিন মিনায় পাথর নিক্ষেপ শেষ করবে সেদিন আসর পর্যন্ত প্রত্যেক সালাতের পর তাকবীর পাঠ করার জন্য বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তাকবীর হলঃ “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।”
জিলহজ্জ মাসের দশম দিনে সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্যে কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। সূরা আল- কাউসারের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ্ বলছেন, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কোরবানী করুন।’
বছরের অন্যান্য সময়ের মতো এই সময়ও গুনাহ থেকে দূরে থাকতে সদা সচেষ্ট থাকা উচিত। এসময় তওবা কবুলেরও শ্রেষ্ঠ সুযোগ। তাই এসময় বেশি বেশি করে নিজের জানা ও অজানায় করা গুনাহের জন্যে তওবা করা উচিত।
এছাড়াও, এই দশদিন বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করা উচিত। পিতা-মাতা ও আত্মীয়দের হক আদায় করা, প্রতিবেশির হক আদায় করাসহ বেশি বেশি সৎ ও ভালো কাজ করা উচিত।
জিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত আর রোজা আরম্ভ হবে আজ থেকে। বছরের শ্রেষ্ঠ এই ১০ দিনের আমল করার আগে খুব ভালো হয় যদি সবাই সূরা হাজ্জের অনুবাদ তাফসীরসহ পড়ে নেন। তাহলে এটা অনুধাবন করতে পারবেন- কী করছেন, আর কেনই বা করছেন?
এই সময়ে নবীদের পিতা, স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালার বন্ধু- হযরত ইব্রাহীম (আ.) সম্পর্কে জানার, পড়ার চেষ্টা করুন। যার করা প্রতিটি দোয়ার উত্তর হচ্ছে আজকের ইসলাম! কোরআনে বর্ণিত ইব্রাহীম (আ.) দোয়াগুলো নিয়ে চিন্তা করলেই দেখবেন মূলত তাঁর করা দোয়াগুলোর উত্তর হিসেবে ইসলামের বিধানসমূহ- নামায, হজ্জ আর কোরবানীর বিধান এসেছে। একটা মানুষ কেমন করে আল্লাহ্র এতো প্রিয় হলেন যে তাঁকে আল্লাহ্ নিজের বন্ধু করে নিলেন? আবার তাঁর করা সমস্ত দোয়াগুলোকে পরবর্তী জাতিদের (খ্রিস্টান, ইহুদী, মুসলিম) জন্য পালন করার বিধান হিসাবে কবুল করে নিলেন? জানতে হলে পড়তে হবে ইব্রাহীম (আ.) এর জীবনী আর তাঁর করা দোয়াগুলো।
“আল্লাহ্ তায়ালার কাছে কখনো (কোরবানির) গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না। বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াটুকুই পৌঁছায়……।” [সূরা আল হাজ্জঃ ৩৭]
প্রশ্ন হল, তাকওয়া কী? তাকওয়া শব্দের অর্থ খোদাভীতি। এই শ্রেষ্ঠ দশদিনের ইবাদাত মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালাকে যেভাবে ভয় করা উচিত সেভাবে ভয় করার যোগ্যতা অর্জন করা উচিত। আল্লাহ্ যেন আমাদের সবাইকে ইবাদাতের এই ভরা মৌসুমে তাঁর পছন্দের বান্দা হওয়ার সামর্থ্য দান করেন। আমীন।
লেখক: সাঈদা জাহান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক