মাবিয়া আফরিন সানির গল্প “নিরুপমার স্বপ্নের রাজকুমার”
মাবিয়া আফরিন সানি
প্রতিটা জীবনেই কিছু গল্প থাকে।
একান্ত নিজের কিছু গল্প।
যা কখনো কাউকেই বলা যায় না,
কখনো কখনো ত নিজেকে ও বলা যায় না।
তবুও কাউকে বলতে খুব ইচ্ছা হয়।
কিন্তুু বলার মতো মানুষ সবাই পায়না।
শুধু বয়ে বেড়াতে হয় পুরো জনম জুড়ে।
একান্ত নিবিড়ভাবে……………
নিরুপমার ও শৈশবে অনেক স্বপ্ন ছিলো। পরিনত বয়সে এসে এখন মনে হয় ওর কাল্পনিক অনুভুতি গুলো দিয়ে এক এক টা গল্প লেখা যেত। ৫/৬ বছর বয়স থেকেই মা দিদার কাছে রাজকুমার, রাজকুমারী, রাক্ষস খোক্ষসের গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে সেই গল্পের মধ্যে ধারণ করে ফেলতো।
“প্রত্যেক টা মানুষের হৃদয়ের ভেতর ই শৈশব থেকেই কারো ছবি আঁকা হতে থাকে। নিরুপমার স্বপ্নে ও এক রাজকুমার ছিলো। অদ্ভুত মায়াবী ছিলো তার চোখ, তার হাসি! কিশোরী নিরুপমা ভাবতো তাকে কোন এক রাক্ষসপুরীতে আটকে রাখা হবে আর একদিন তার স্বপ্নের রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে এসে তাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। রাজকুমার কে ঘিরে হাজারো সুখের ছবি আঁকা ছিলো তার মনোঃস্পাটে।
কিন্তু বাস্তবে নিরুপমার সেই রাজকুমার এর ছবি ধূসর হতে শুরু করে নির্মম বাস্তবতার আড়ালে। সে বন্দী হয়ে যায় অন্য কারো সোনার খাঁচায়। ছেলেবেলার সেই গল্পের মত রাজকুমার তাকে এই খাঁচা থেকে মুক্ত করতে আর ছুটে আসেনি……!
কিন্তু রাজকুমার এর ছবিটা তার হৃদয় থেকে মুছে যায় নি । এই জীবনে না হউক, পরের জন্মে ও যদি সেই রাজকুমার এর দেখা পায়, ঠিক চিনে ফেলবে নিরুপমা!
নিরুর জীবনে কোন প্রেম ছিলো না। ২৫ বছর সংসার করেছেন, সব দ্বায়িত্ব পালন করে গেছেন। স্বামী সন্তান সংসার সব ই ছিলো। সব কিছুর মধ্যে ও নিরু ভীষণ একা। কিছু খারাপ বা ভালোলাগার অনুভুতি শুধু নিজের ই থাকে যা অন্য কাউকে শেয়ার করা যায় না! স্বভাবসুলভ নিরব নিরুর বন্ধু বান্ধব আড্ডা নেই বললেই চলে। ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে।কিন্তু হেলুসেশন বা স্বপ্ন যেটাই হোক। নিরু মাঝে মাঝেই সেই মুখ টা স্বপ্ন দেখতেন। কি অদ্ভুত না! বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব ই নেই। কত জীবন্ত একটা স্বপ্ন কে বছরের পর বছর লালন করেছেন।
কী হচ্ছে আমার এসব! মাঝে বকা ও দিতেন রাজকুমার কে।
যেন তুমি ছাড়া জগতে কোনও মানুষ নেই, কোনও কবি নেই, কোনও পুরুষ নেই, কোনও
প্রেমিক নেই, কোনও হৃদয় নেই!
অনেক হয়েছে ওসব, এবার অন্য কিছু হোক,
অন্য কিছুতে মন পড়ে থাক, অন্য কিছু অমল আনন্দ দিক।মন নিয়েই যত ঝামেলা আসলে, মন কোনও একটা জায়গায় পড়ে রইলো তো পড়েই রইল।মনটাকে নিয়ে অন্য কোথাও বসন্তের রঙের মত যে ছিটিয়ে দেব, তা হয় না।
সবারই হয়তো সবকিছু হয় না!
তারপর…..
বেলা শেষে জীবনের গোধূলী বেলায় কাকতালীয়ভাবে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় নিরুপমার। সারাজীবন এর সঞ্চয় দিয়ে ঢাকার কোলাহল থেকে বহু দূরে একটা আশ্রম বানিয়েছে সে। এখানে এতিম অসহায় বাচ্চাদের আর অসহায় বৃদ্ধদের থাকার ব্যাবস্থা রয়েছে। বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই এটা কোন আশ্রম। এত সুন্দর গাছপালা ফুল পাখি পুকুর সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ।। নিরুপমার একমাত্র ছেলে বিয়ে করে বাবার ব্যবসা সাম্লাচ্ছে । মা কে ও নিয়ে যেতে চেয়েছে। নিরু যায় নি। স্বামী মারা যাবার পর বেশ কিছুদিন ব্যবসা সাম্লিয়েছেন নিরু নিজেই। তারপর ছেলের হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে এসেছেন আশ্রমে। এটা তার স্বপ্ন ছিলো। জীবনের শেষ সময় টা সে পরিবার থেকে অনেক দূরে কোথা ও চলে যাবেন। যতদিন শক্তি থাকবে অসহায়দের পাশে থাকবেন।
সব ই ঠিক ঠাক চলছিলো। কিন্তু…
রাত নয় টার মত বাজে। এমন অজ পাড়াগাঁয়ে এখন অনেক রাত। জনবসতি খুব কম। বেশ দূরে দুই একটা বাংলোর মত আছে। কিছু কেয়ার টেকার সেগুলো দেখাশুনা করেন। আর বাংলোর মালিকেরা মাঝে সাঝে অবকাশ যাপন করতে আসেন।সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঝিঝি পোকা আর শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ছে নিরুপমা!
হঠাত একটা গাড়ি এসে থামলো আশ্রমের সামনে। আশ্রমের দীর্ঘদিন এর কেয়ার টেকার রহমত মিয়া দৌড়ে এসে বললেন আম্মা একজন ভদ্রলোক ভীষণ অসুস্থবোধ করছেন। সাথে উনার ড্রাইভার ছাড়া কেউ নাই। উনারা ঢাকায় ফিরছিলেন কিন্তু হঠাত তাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। উনার ড্রাইভার খুব অনুরোধ করছে স্যার কে আজ রাতটা যদি এখানে থাকতে দেয়া হয় তাহলে অনেক কৃতজ্ঞ থাকবেন। নিরুপমা বললো একটা ঘরে ভদ্রলোক এর থাকার ব্যাবস্থা করো। উনার আপ্যায়নে যেনো কোন ত্রুটি না হয়।
প্রতিদিনের মত খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আশ্রম টা ঘুরে দেখেন নিরুপমা। রহমত মিয়া এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বল্লেন আম্মা গতকাল যে স্যার আশ্রমে আসছেন উনার খুব জ্বর। কাল থেকে কিছুই খান নি। উনার ড্রাইভার শহরে গেছেন মেকানিক আনতে। আপনি কি একবার যাবেন আম্মা? ঠিক আছে চলো। আচ্ছা আমি দেখছি।তুমি একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসো।
নিরু হাল্কা কাশি দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রলোক পাশ ফিরে জ্ব্ররের ঘোরে কাঁপছেন। এই যে শুনছেন? কেমন বোধ করছেন এখন? কোন সাঁড়া নেই। নিরু চাঁদরটা গায়ে উপর দিয়ে দিলেন। উনার মাথায় পানি পট্টি দিতে হবে। লোক টা অন্য দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। নিরু পানি রুমাল এনে বেশ কয়েকবার ডাক্লেন। লোক টা কথা বলতে পারছেন না। নিরু পাশে বসে অসস্তি সত্ত্বেও লোক টার কপালে হাত রাখলেন। জ্ব্ররের ঘোরে কাতরাচ্ছেন । নিরু কপালে পানি পট্টি দিচ্ছেন। লোক্টা কে সোজা করে শুইয়ে দেয়া দরকার। রহমত মিয়া থাকলে ভালো হত। নিরু পেছন থেকেই জলপট্টি দিচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর লোক্টার জ্ঞান ফিরলো। কপালে পানির স্পর্শ অনুভব করে চোখ মেলে তাকালেন। কষ্ট করে সোজা হয়ে নিরুর দিকে ফিরে ভুত দেখার মতো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। নিরু ও চমকে উঠলেন। কে এই ভদ্রলোক! এই চোখ এই মুখ তো তার খুব চেনা। শৈশব থেকে যার ছবি সে কল্পনায় আকতো। এত স্পষ্ট কোন স্বপ্ন কোন মুখ নিরু বাস্তবে ও দেখেনি। সেই রাজকুমার! যে জীবনে আসবে বলে স্বপ্নের দোলা দিয়েছিলো নিরুর কিশোরী মনে। তারপর আর স্বপ্ন দেখা হয় নি, অপেক্ষা ও করেনি তার স্বপ্নের রাজকুমার তার জীবনে আসবে । দুই জোড়া চোখ অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। নিরু বুঝতে পারছে না তার স্বপ্নের রাজকুমার কিভাবে তার সামনে আসবে।
না না নিশ্চয় ই স্বপ্ন দেখছে সে।
স্বপ্নই মনে হয়!
হঠাৎ ঝড়ে উড়ে হৃদয়ের উঠোনে
যেনো অনেক প্রত্যাশিত অনেক কালের দেখা স্বপ্ন এসে দাঁড়ালে!