তারুণ্যের ভাবনায় একুশে ফেব্রুয়ারি
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।
৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বায়ান্নোর ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রাণ বিসর্জন দেয় এদেশের বীর সন্তানেরা। ভাষা শহীদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা পাই প্রাণের ভাষা বাংলা, মা ডাকার অধিকার। সেদিন সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর, অহিউল্লাহসহ আরো অনেক তরুণরাই মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের লক্ষ্যে ঢাকার পিচঢালা রাজপথে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষাবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০০০ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভাবনা তুলে ধরেছেন মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।
তারুণ্যের শক্তি মাতৃভাষা
মায়ের শেখানো মাতৃভাষা পরিবেশ, পরিস্থিতি বা অবহেলায় সেই পরম মমতা এক সময় হ্রাস পায়। জেনে বা না জেনে শুরু হয় বিকৃতি, অপব্যবহার। আধুনিকতার নামে ভিনদেশী সংস্কৃতি চর্চায় আজ মত্ত তরুণ সমাজ। বিশেষত ভিনদেশী টিভি সিরিয়াল বা ওয়েব সিরিজের গল্প থাকে বর্তমান সময়ের তরুণদের মুখে মুখে। বাংলা ভাষায় রুচিসম্মত নাটক, সিনেমা বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নির্মাণ না হওয়াই যার কারণ। এছাড়া উচ্চশিক্ষা এবং সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই, যা বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তাকে কমিয়ে দিচ্ছে। সর্বোপরি, ভাষাকেন্দ্রিক সচেতনতা, আবেগ কিংবা নিজস্ব সংস্কৃতিবোধের জায়গাটি নিশ্চিত করতে পূর্বসূরিদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। হোক প্রতিজ্ঞা- যে মুখে মা বলবো, সে মুখেই মায়ের ভাষার সন্মান রক্ষা করবো।
অনন্য প্রতীক রাউত
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
একুশ হোক অহংকার
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনের অমর অধ্যায়। ১৯৫২ থেকে ২০২১ সাল, পেরিয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর। একুশ আমাদের অহংকার, একুশ মানে মাথা নত না করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, একুশ মানে চেতনার উজ্জীবন। একুশ মানে তারুণ্যের শক্তি, যে শক্তির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল মাতৃভাষার সম্মান। একুশের অহংকার এখন শুধু আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সমাদৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান। কিন্তু আধুনিকতার নামে যদি অবহেলিত হয় বাংলা ভাষার সম্মান তাহলে ব্যর্থ হবে শহীদদের আত্মত্যাগ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সদিচ্ছা ও সাবলীল ব্যবহারই পারে একুশের চেতনাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অক্ষত রাখতে।
নাজিয়া আফরিন
শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা জরুরি
প্রতিবার শিমুল ফুলগুলো ভাষা শহিদদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও, আমারা বাংলা ভাষার মর্যাদা ধরে রাখতে পারছি না। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হরহামেশাই ব্যবহার করছি বাংলিশ। ছোটদের ভুলিয়ে রাখছি হিন্দি কার্টুন দেখিয়ে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিদেশি সংস্কৃতি একটু বেশিই ফুটিয়ে তুলছি। ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহারকেই ধরে নিয়েছি আধুনিকতার প্রতীক। এতে করে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ভয়ানক। এ প্রজন্ম হয়তো একসময় শুদ্ধ বাংলা সহজে লিখতে ও পড়তেও ভুলে যাবে। এখনি সময় এর থেকে বেড়িয়ে আসার। ভাষার প্রতি দেশের প্রতি মমত্ববোধ জাগাতে হবে। পারিবারিক শিক্ষায় দেশপ্রেমকে প্রবল করতে হবে।
রুকাইয়া মিজান মিমি
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যবহার ও চর্চায় সচেতনতা
মাতৃভাষা হলো মানব অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান একটি অবলম্বন। যে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি প্রাণ দিয়েছিল, সেই ভাষার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে তরুন সমাজের যথাযথ সচেতনতা নেই। বর্তমানে তরুনদের মধ্যে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার ও চর্চা বেশি। বর্তমানে তরুনরা আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন, চাকরি, অফিস-আদালত সহ প্রতিক্ষেত্রেই ইংরেজি ভাষাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না, নিজস্বতা হারাচ্ছে বাংলা ভাষা। তরুণ সমাজ সচেতন হলেই বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চা বৃদ্ধি পাবে, এই ভাষাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। তাই এই মাতৃভাষাকে ও একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে তরুন সমাজকে।
সিদরাতুল মুনতাহা
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
হৃদয় জুড়ে মাতৃভাষা
বাঙ্গালি জাতির অন্যতম এক অর্জনের নাম মাতৃভাষা ‘বাংলা’। যার পিছনে রয়েছে অজস্র রক্তের মূল্য, হয়েছিল দফায় দফায় আন্দোলন। বাংলার গৌরব ও ঐতিহ্য জুড়ে বহমান এই মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য দিতে হয়েছে অনেক আত্মত্যাগ, দৌরাত্ম, সহ্য করতে হয়েছে নির্মম অত্যাচার। আর এই আন্দোলনের অবসান ঘটে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে। বাঙালিরা নিজস্ব করে নেয় বাংলার বুকে মাতৃভাষা। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা সেই অমূল্য সম্পদ মাতৃভাষাকে অবমূল্যায়ন করছি, বিকৃতভাবে ব্যবহার করছি। ভাষার মাধুর্যতা উপলব্ধি করতে পারছি না। আমাদের ভাইয়েরা অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করে যে মাতৃভাষাকে আমাদের কাছে আমানত হিসেবে রেখে গিয়েছিলো তা পালনে আমরা ব্যর্থ। সর্বমহলে বাংলা ভাষাকে যেন শুদ্ধতার সাথে ব্যবহার করা হয়। এবং প্রতিটি বাঙালির হৃদয় জুড়ে যেন থাকে মাতৃভাষা বাংলা।
রিদুয়ান ইসলাম
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়