প্রাচ্যের হার্ভার্ড হবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

কামারুজ্জামান শানিল।

“এই মাম্মা একটু দাড়ান, লেজি বয় দৌড়ায়া আইতাছে।” এসে বাসে পা দিতেই সমগ্র বাস কোলাহলে পরিপূর্ণ, “ব্যাটা সারাজীবন অলসই থাকবি? প্রতিদিন তোর দেরি হয় কেন?”

এভাবেই শুরু হয় একটি সকাল। দোতলায় জানালার পাশের সিটে বসে বাইরে তাকিয়ে স্নিগ্ধ আলোর রঙিন ভোরে, প্রশান্তিময় পরিবেশে নির্মল বাতাসে, তথাকথিত বখাটে ছেলেদের ন্যায় বড় বড় চুল উড়িয়ে, সকালটা উপভোগ করতে করতে লাল বাস এসে হাজির হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অতিবাহিত করা এই ছোট্ট সময়টুকুতে এভাবেই শুরু হয় প্রতিটি দিবস। অতঃপর ক্লাস শুরু হবার পূর্ব অবধি তো আড্ডা চলে শান্ত চত্বরে! কেউ কেউ ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার নিয়ে খোশগল্পে নিমজ্জিত হয়ে যায়। কেউ টিএসসিতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হাজারো দুষ্টুমিতে মাতিয়ে তুলে মুহুর্তগুলোকে। কেউ কাঁঠালতলায় রংতুলি আর আর্টপেপার নিয়ে আপন চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে ছবি আঁকতে থাকে। আবার কেউ উসকো খুসকো চুল, সাদা পাঞ্জাবি, গোল চশমা পরিহিত অবস্থায় ভিসি ভবনের পেছনে ডায়েরি কলম হাতে নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূর আসমানের পানে।

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলছি। সেই ছোট্ট ক্যাম্পাসটি যখন ভবিষ্যৎ গঠনের কারিগরদের পদচারণায় মুখরিত হয় মস্ত কোলাহলে, তখন মনে হয় এখানে রয়েছে কিছু সজীব প্রান, কিছু ভালোবাসায় সিক্ত মূহুর্ত, কিছু আবেগ, কিছু মায়া, কিছু সুদুরপ্রসারি স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা।

ক্যাম্পাস হিসেবে হয়ত কারও পছন্দের তালিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না। পুরান ঢাকার সেই প্রাচীন স্কুল থেকে কলেজ এবং পরবর্তিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হওয়া এই ক্যাম্পাস হয়ত দিতে পারে নি আশানুরূপ খোলামেলা সুন্দর পরিবেশ। হয়ত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় এখানে নেই সুবিশাল এলাকা। রয়েছে আবাসন সংকট, রয়েছে ক্লাসরুম সংকট, রয়েছে শিক্ষা উপকরণ সংকট। তবুও কেন এখানকার শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসকে এতটা ভালোবাসে? কেন এই সীমাবদ্ধতাকে এতটা আপন করে নিয়েছে?

কারন, এই ক্যাম্পাসে রয়েছে প্রান, রয়েছে সাফল্য, রয়েছে ঐতিহ্য, রয়েছে নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে টিকে থাকার প্রেরনা। রাজনীতি কিংবা প্রভাবশালীদের দাপটে একে একে বিলীন হয়ে যাওয়া ১১টি আবাসিক হল ও তাদের শেওলা ধরা জীর্ণশীর্ণ দেয়াল যেন ফিসফিসিয়ে বলে দেয়, “আমিই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়”। হয়ত অর্থনৈতিক দুরাবস্থা মোকাবিলা করে মেসে বসবাস করা একজন দরিদ্র শিক্ষার্থী তার সাফল্য নিয়ে সবার সম্মুখে মাথা উঁচু করে বলে দেয়, ” আমিই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়”। এ যেন সেই চার্লস ডারউইনের “সার্ভাইবল অব দ্য ফিটেস্ট”। ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই যখন প্রাচীন নিদর্শনের ন্যায় ভিসি ভবন আর শীতল বাতাসে কৃষ্ণচুড়ার দোল খাওয়া লালচে পরিবেশ গোচরীভূত হয়, তখন যেকোনো ব্যাক্তির কাছেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতাকে তুচ্ছ মনে হবে। মনে হবে প্রবেশ করেছে এক স্বপ্নের রাজ্যে। যেন প্রতিটি দিবসই মেতে ওঠে উৎসবে।

বেলা গড়াতেই দেখা যায় শহীদ মিনারের সামনে কেউ গিটার হাতে টুংটাং করছে আর গলা ছেড়ে গান গাইছে। কেউ ইনডোর গেইমে মেতে উঠছে দাবা, ক্যারোম কিংবা টেবিল টেনিসে। আবার কেউ দলবল নিয়ে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে (ধুপখোলা মাঠে)। এ যেন এক উৎফুল্ল পরিবেশ। যেখানে নেই কোনো হতাশা, নেই কোনো গ্লানি। মানুষগুলোকে দেখে যেন হয় এরা সবাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী।

Post MIddle

বিকেল বেলা আবার সেই লাল বাসে বাসায় ফিরে আসার আনন্দ যেন নতুন মাত্রা যোগ করে। যাত্রাপথে বাসে জমে ওঠে দারুন আড্ডা। কেউ পেছনের দরজায় নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে আবার কেউ কেউ গলা ছেড়ে গান গেয়ে উপভোগ করে ভ্রমনটা। ভালো লাগে যখন বেসুরা গলায় সম্মিলিত কণ্ঠে গানের শব্দ শুনে মানুষ ঊঁকি দেয় লাল বাসটার দিকে। ভালো লাগে যখন দূর হতে কোনো এক বয়ষ্ক লোক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কল্পনায় ফিরে যায় তার যৌবনে কাটানো সময়গুলোতে।

শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়কে কতটা ভালোবাসে তা ব্যাখ্যা করা দায়। বলা হয়ে থাকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকে একেকজন উন্মাদ। এরা ক্যাম্পাসের তুচ্ছ বালুকনাকেও আপন করে নেয়, যেন পবিত্র ধুলিতে মাখিয়ে নেয় নিজেকে। আবার এদের দ্বারাই গড়ে ওঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ। এরা কখনও অন্যায়কে মেনে নিতে পারে না। কারন সংকট কিংবা সীমাবদ্ধতার মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো অনেক বাস্তববাদী এবং প্রতিবাদী হয়। তাইতো এরা প্রফেশনাল পর্যায়েও এতটা সফল হয়।

এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য ইতিহাস তুলে ধরা যাক। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত “ব্রাহ্ম স্কুল” ১৮৭২ সালে তার বাবার নামে “জগন্নাথ স্কুল” নামকরন করা হয়। ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ স্কুলকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ এবং ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজ হিসেবে উন্নীত করা হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক, জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। সর্বোপরি তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের সমগ্রটুকু নিয়েই প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৯ সালে আবার স্নাতক কার্যক্রম চালু করা হয় এবং ১৯৬৮ সালে সরকারীকরণ করা হয়। অতঃপর দীর্ঘদিন জগন্নাথ কলেজ দেশের মানসম্মত কলেজ হিসেবে অবদান রেখে আসে। অবশেষে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫” পাশের মাধ্যমে জগন্নাথ কলেজকে উন্নীত করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

২০২০ খ্রিস্টাব্দে এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পরিপূর্ণ হলো। প্রবেশ করল ১৬ তম বর্ষে। এই ১৫ বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া অনেক, এর অর্জন হাত তুলে স্যালুট করার মত। বিসিএস সহ দেশের বড় বড় চাকুরী ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম সর্বোপরি সমাদৃত। আশাকরি আমাদের এই প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় একদিন অধিষ্ঠিত হবে আরও উচ্চ মঞ্চে। একদিন সমগ্র বিশ্ব জানবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে। স্বপ্ন দেখি একদিন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড না হলেও প্রাচ্যের হার্ভার্ড হবে আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। হয়ত সেদিন বুকে হাত রেখে বলব, “আমি একজন গর্বিত জবিয়ান।”

একদিন এই আবাসন সংকট থাকবে না। হয়ত শতভাগ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ব্যাবস্থা হবে। একদিন এই ক্লাসরুম সংকট থাকবে না। হয়ত একেকটি ডিপার্টমেন্টের জন্য থাকবে একেকটি কমপ্লেক্স। হয়ত কোনো শিক্ষা উপকরণ সংকট কিংবা ল্যাবরেটরি সংকট থাকবে না। হয়ত সুবিশাল গ্রন্থাগারে অগণিত বই অধ্যয়ন করবে শিক্ষার্থীরা। হয়ত এত সরু সংকীর্ণ পথের পরিবর্তে থাকবে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পথ। হয়ত থাকবে এঁকে বেঁকে চলা হ্রদ আর পাখির কলকাকলিতে মুখরিত প্রাঙ্গন। তখন আর ধুপখোলা মাঠে গিয়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে না, তখন হয়ত থাকবে স্টেডিয়াম। দুইশ একরের নতুন ক্যাম্পাসে হয়ত থাকবে না কোনো সীমাবদ্ধতাই, তৈরি হবে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে উন্নত ও আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, যা দেখার জন্য পর্যটকরা ভ্রমন করবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

হয়ত কোনো এক বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুদেরকে নিয়ে চলে যাব নতুন ক্যাম্পাসে। হয়ত কোনো এক হ্রদের পাড়ে বসে নির্মল বাতাসের ছোঁয়ার শিউরে উঠবে শরীর। পাখিদের কলকাকলীতে পরিপূর্ণ অপরাহ্ণে স্মৃতিচারণ করব আর বলব, “দেখ, এইত আমার পরিপূর্ণতায় গড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।” একটা দীর্ঘ প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেই কাঁঠালতলার আড্ডার কথা স্মরণ করব।

কামারুজ্জামান শানিল
পরিসংখ্যান বিভাগ।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পছন্দের আরো পোস্ট